সৈয়দা উস্তুআনা হান্নানা
নিচে তাকিয়ে দেখি পিচ্চি পিচ্চি কিছু ঘরবাড়ি, অল্প কিছু গাছ আর পর্বত। হিমালয়ের দেশ যে! নেপাল। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই একটা হিমেল হাওয়া লাগল গায়ে। যাক, শেষ পর্যন্ত আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত স্টাডি ট্যুরে এলাম তাহলে। এটা শুধু মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের পঞ্চম ব্যাচের দেশের বাইরে প্রথম স্টাডি ট্যুর নয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিপার্টমেন্টের প্রথম দেশের বাইরে শিক্ষা সফর।
সফরটা ছয় দিনের। আমাদের নিত্যসঙ্গী ছিল চমৎকার একটা বিশাল বাস। আমরা ২১ জন ছাত্রছাত্রী আর চারজন টিচার আয়েশ করে ঘুরেছি। প্রথমে ছিলাম কাঠমাণ্ডুর থামেলে, দ্য চয়েস নামে এক হোটেলে। দুদিন ঘুরলাম কাঠমাণ্ডুতেই-বৌদ্ধনাথ স্টুপা, পশুপতিনাথ মন্দির, শম্ভুনাথ মন্দিরে। বিশাল বিশাল মন্দির। হাজার হাজার কবুতর উড়ছে আর বসছে। মন্দিরগুলোয় শুধু যে নেপালিরা আরাধনা করছে তা নয়, অনেক বিদেশিকেও ‘জপ’ করতে দেখেছি। গিয়েছিলাম ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেশ বড়। বিল্ডিংগুলোও সুন্দর। ল্যাবরেটরি বিল্ডিং আলাদা। গাছগাছালি প্রচুর। দলবেঁধে খেতে যেতাম। ভাত, পাপড়, সবজির তরকারি, শাক, ডাল। কখনো খাসির ভুনা। ওদের চা-টা অসাধারণ। ভালো লেগেছে নেপালি মানুষের আতিথেয়তা, তাদের ব্যবহার। এমনও হয়েছে, গাড়ি থামিয়ে আমরা রাস্তায় ছবি তুলছি, পেছনে কয়েকটা গাড়ি এসে থেমে আছে, হর্ন পর্যন্ত বাজায়নি!
১৫ ডিসেম্বর রওনা হলাম পোখারা। যাওয়ার পথে দেখলাম বাস শুধু ওপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই। ঘোরানো পাহাড়ি রাস্তা। মাঝেমধ্যেই ঝরনা চোখে পড়ছিল। আর পাহাড়ি নদী। প্রচণ্ড স্রোত। দূর থেকে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পেয়েছি। একটা জায়গায় নামলাম, সেখানে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটা নদী। পানি খুবই স্বচ্ছ, নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। পানিতে নামলাম। খুবই ঠাণ্ডা পানি। আরো কিছু জায়গা ঘুরে রাতে পৌঁছলাম হোটেল তিব্বত হোমে।
পরদিন ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবসে এই প্রথম দেশের বাইরে। বিশাল একটা জাতীয় পতাকা নিয়েছিলাম সঙ্গে। কয়েক জন নিয়েছিলাম মাথায় পরা ব্যাচ, ছোট ছোট পতাকা। সকালে বেরিয়ে প্রথমেই ফেওয়া লেক। কী যে সুন্দর! চারপাশে পাহাড়। একপাশে দেখা যায় হিমালয়ের দুটি চূড়া-অন্নপূর্ণা আর মাচাপুচারি। বরফে ঢাকা। চূড়ার অনেক নিচে ঝুলছে টুকরো টুকরো মেঘ। মনে হয় ওই পাহাড়টায় গেলেই ছুঁতে পারব! সাধারণত ট্যুরিস্ট দেখলে নেপালিরা তাকায় না। কিন্তু সেদিন সবাই অবাক হয়ে আমাদের দেখছিল। কিছু লোক পেছন থেকে ডাকছিল অল্প জানা বাংলায়-‘বন্ধু, কেমন আছো?’
এরপর গেলাম ডেভিস ফলসে। বিশাল ঝরনার পানি গিয়ে পড়ছে গভীরে। ওপর থেকে দেখা যায় না। সেখান থেকে গুপ্তেস্বর মহাদেব গুহায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম আশপাশে পাথর কেটে বিভিন্ন শিল্পকর্ম করা।
এরপর গেলাম সেতি নদী দেখতে। তারপর সারাংকোট নামের গ্রামে। পর্বতের ঢালে ঢালে বাড়ি, আর কিছু জায়গা সমতল করে জুম চাষ করছে। সেখানে এক বিশাল পর্বতের চূড়ায় যখন উঠলাম, প্রচণ্ড ক্লান্তি আর ভীষণ আনন্দের অনুভূতি পেয়েছিলাম একই সঙ্গে। নামার সময় দেখলাম, অন্নপূর্ণার ওপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণিমার বিশাল চাঁদ। সেই চাঁদ দেখে সত্যি স্তম্ভিত হয়েছিলাম সেদিন।
পরদিন ভোরে গেলাম একটা বৌদ্ধ মন্দিরে। পাথর দিয়ে বানানো সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠছি তো উঠছি। মাঝপথে হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখি মেঘ ঝুলছে। তার মানে আমরা মেঘের ওপরে!
১৮ তারিখ দুপুরে ফ্লাইট। মাঝ রাতে গেলাম নাগরকোট। সূর্যোদয় দেখতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কুয়াশার কারণে দেখতে পারিনি। তবে মজা হয়েছিল খুব। সেখানে ছিল জাপানি আর চায়নিজদের একটা দল। এমরান স্যার আর রাফিয়াদ স্যারের নেতৃত্বে অভিনব কায়দায় আমরা সবাই স্যালুট জানালাম হিমালয়কে। ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে তুললাম ছবি। আর চায়নিজরা করল কী, আমরা যখন যে ভঙ্গিতে ছবি তুলি পর মুহূর্তে তারাও সেই ভঙ্গিতে ছবি তোলে!
নকল করা ওদের স্বভাব জানি, তাই বলে এতটা!
লেখক : পঞ্চম ব্যাচ, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল। সূত্র : কালের কণ্ঠ