শাপলা বড়ুয়া
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মৃতি বিজড়িত করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধগুলোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সেই সময় তুলে ধরতে ভাস্কর্যশিল্পীদের অবদান অতুলনীয়। কেননা তাদের নিরলস প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমেই এক একটি ভাস্কর্য আজ মূর্তমান হয়ে উঠেছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ
স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণবিসর্জনকারী শহীদদের স্মরণে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নবীনগরে নির্মিত হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সৈয়দ মঈনুল হোসেনের স্থাপনায় এ স্মৃতিসৌধে সাতজোড়া ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভ রয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি সময়কালকে নির্দেশ করতেই নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিসৌধের চত্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের দশটি গণকবর। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর শেখ মুজিবর রহমান এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮২ সালে শেষ হয় এর নির্মাণ কাজ।
জাগ্রত চৌরঙ্গী
শিল্পী আব্দুর রাজ্জাকের হাত দিয়ে উঠে আসে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ স্মৃতিসৌধটি। এক হাতে গ্রেনেড, অন্য হাতে রাইফেল উঁচিয়ে ধরা, লুঙ্গি পরা ও খালি গায়ের এই ভাস্কর্যটি; ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনদানকারী হরমত আলী ও অন্যান্য শহীদদের স্মৃতিকেই তুলে ধরেছে। ১৯৭১ সালে নিমির্ত হয় এটি। জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে অবস্থিত এ স্মৃতিসৌধের দুই পাশের ফলকে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ ও ১১ নম্বর সেক্টরের ২০৭ জন শহীদ সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম উৎকীর্ণ করা আছে।
বিজয় ’৭১
বাংলাদেশের পতাকা হাতে একজন কৃষক, তার ঠিক পাশেই রাইফেল হাতে সংগ্রামী নারী, কাঁধে রাইফেল ও গ্রেনেড ছোঁড়ার ভঙ্গিমায় একজন ছাত্র, এভাবেই বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণকে ‘বিজয় বাংলা’-র ভাস্কর্যের মাধ্যমে মূর্তমান করে তুলেছেন ভাস্কর্যশিল্পী শ্যামল চৌধুরী। এই ভাস্কর্যের সঙ্গে জুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাবলীও। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতেই জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনেই ২০০০ সালে নির্মিত হয় এই স্মৃতিসৌধটি।
সাবাশ বাংলাদেশ
রাকসু ও ছাত্র এবং জনগণের আর্থিক সহায়তায় ভাস্কর্যশিল্পী নিতুন কুণ্ডের শৈল্পিক নিপুণতায় রূপ পায় ‘সাবাশ বাংলাদেশ’। অসম সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর সঙ্গে মুষ্টিবদ্ধ হাতে বিজয় উল্লাসে ফেটেপড়া অন্য আরেক মুক্তিযোদ্ধার বীরদর্পে দাঁড়িয়ে থাকা এই সৌধটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তাঙ্গনের উত্তরপাশে অবস্থিত, যা মুক্তিযুদ্ধের সময়কেই প্রতিভাত করছে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে রাজশাহীর আপামর জনসাধারণ। শহীদ হন অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। এরই সূত্র ধরে ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে শহীদ হন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারসহ অসংখ্য কর্মকতা-কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রী। তাদের স্মৃতিকে অম্লান করতেই ১৯৯২ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম উদ্বোধন করেন এই স্মৃতিসৌধটি।
স্মৃতি অম্লান
বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘স্মৃতি অম্লান’। এ স্মৃতিসৌধের রয়েছে তিনটি স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভের সঙ্গে আছে ২৪টি ধাপ। মূলত ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় ও স্বাধীনতাকে তুলে ধরতেই এই ধাপগুলো। সেই সঙ্গে দুই লাখ নির্যাতিতা মা-বোনের বেদনার আর্তি প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়েছে স্মৃতিসৌধের বেদীমূলে থাকা সাদা-নীলাভো পাথরের খণ্ডও। রাজশাহী শহরের দ্বীনেভদ্রা মোড়ে অবস্থিত এ সৌধটি শিল্পী রাজিউদ্দিন আহমদের সৃষ্টিশীল প্রয়াসে ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিকে মূর্ত করছে আজও।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ আম্রকাননে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথের ঘটনাকে চির অম্লান করে রাখতে ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। পরবর্তীকালে বৈদ্যনাথতলার নাম বদলে রাখা হয় মুজিবনগর। এই স্থানটিকে স্মৃতি বিজরিত করতে প্রতিটি ঘটনাকে প্রতীকী হিসেবে তুলে ধরা হয়। যার অন্যতম নিদর্শন হলো লালমঞ্চ, যেখানে শপথ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সৌধের ২৩টি স্তম্ভের মাধ্যমে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরের পর্যায়ক্রমিক সংগ্রামকে তুলে ধরা হয় এতে। সেই সঙ্গে সৌধের প্রাচীরে রয়েছে অগণিত ফোকর, যা পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। এক লাখ বৃদ্ধিজীবীর গণহত্যাকে ইঙ্গিত দিতে বেদীতে পাথরের অসংখ্য গোলাকার খণ্ড ব্যবহার করা হয় এবং ৩০ লাখ শহীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হিসেবে বসানো হয় ৩০ লাখ পাথর। এভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নানান পর্যায়কে প্রতীকী হিসেবে তুলে ধরেছেন ভাস্কর্যশিল্পী তানভীর করিম।
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ও তাদের দোসর এ দেশীয় রাজাকার-আলবদদের সহযোগীতায় এ দেশকে মেধাশূণ্য করার ষড়যন্ত্র নিয়ে নির্দয়ভাবে হত্যা করে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের। তাঁদের স্মরণ করতেই ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর নির্মাণ করা হয় এই স্মৃতিসৌধটি। সেই সময়ে অগণিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে মিরপুর এলাকায় ফেলে রাখে, তাই শিল্পী মোস্তফা হারুন কুদ্দুসের নির্মিত এই সৌধটি ঢাকার মিরপুর ১ নম্বর মাজার রোডে নির্মাণ করা হয়। কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধের গড়নে এতে চারটি স্তম্ভ রয়েছে। বেদীর ওপর চড়ানো হয়েছে সাদাটে পাথরের একটি ফলক। চারটি প্রাচীর ও বেদীর সবটাই লাল ইটের গাঁথুনি দিয়ে মোড়ানো।
রায়েরবজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ
পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরবাহিনী এদেশের অগণিত মানুষকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি, এদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার যড়যন্ত্রেও লিপ্ত থেকে ছিলেন তারা। যার ফলস্বরূপ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। বিজয়ের দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বধ্যভূমির ইটভাটার সামনে খোলা জায়গায় অগুনতি বুদ্ধিজীবীদের হাত-পা-চোখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখেছিল। ১৮ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের স্মরণে ১৯৯৯ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের পাশে শিল্পী ফরিদউদ্দিন আহমেদ ও মোহাম্মদ জামি আল শাফির সম্মিলিত উদ্যোগে নির্মাণ করা হয় এই স্মৃতিসৌধটি। সৌধের প্রাচীরের লাগোয়া কৃত্রিম জলাশয় স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই কালো অধ্যায়কেই প্রতিফলিত করছে যেন। সৌজন্যে : রাইজিংবিডি