Skip to content

হাঁকাও গাড়ি চিলমারীর বন্দরে

:: আব্দুল খালেক ফারুক ::

সময়টা তখন দুপুর। শীতের আগমনী ধ্বনিতে রোদের তেজ কমে এসেছে অনেকটাই। চিলমারী বন্দরে পৌঁছানোর পর চোখে পড়ল, দুটি শ্যালোচালিত ট্রিলার দাঁড়িয়ে আছে। চালে বোঝাই। সম্ভবত খালাসের অপেক্ষায়। একটু পরই হয়তো নৌকায় বোঝাই করে এই মালপত্র নিয়ে গন্তব্যে ছুটবে ব্যাপারীরা।

‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’ ভাওয়াইয়াসম্রাট খ্যাত আব্বাসউদ্দীনের এই গান বিখ্যাত করেছে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরকে। কিন্তু এখন আর সেই গরুর গাড়ি আর গাড়োয়ানের দেখা মিলল না। তবে টি স্টলের অডিও সেট থেকে ভেসে এলো ভাওয়াইয়াগানের সুর। প্রাচীন এই বন্দরের সেই হাঁকডাক না থাকলেও ভারতের আসাম ও কলকাতা রুটের মাঝখানে ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে ব্রহ্মপুত্রপারের চিলমারী বন্দর।

চিলমারীর মাটিকাটা মোড় থেকে রমনা ঘাটে অবস্থিত বন্দর এলাকার দূরত্ব তিন কিলোমিটার।

মোটরসাইকেলে বন্দরে পৌঁছার পর চোখে পড়েছিল একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ‘চিলমারী নদীবন্দর’। তার পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরেকটি সাইনবোর্ডে ব্রহ্মপুত্রের তীররক্ষা প্রকল্পের বর্ণনা। সাইনবোর্ডের নিচে শানবাঁধানো বেঞ্চে বসে আছে কয়েকজন বন্দর শ্রমিক। তাদের অলস সময় কাটাতে দেখে মনে হয়, কর্মব্যস্ততা নেই তেমন একটা। কিছুক্ষণ পর পর রৌমারী, রাজীবপুর, যাত্রাপুর, হাতিয়া, অষ্টমীরচর, মোল্লারহাটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসছে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌকা। নৌকা থেকে নেমেই যাত্রীরা তিন চাকার বিভিন্ন যানে চেপে ছুটছে নিজ নিজ গন্তব্যের পথে।

সামনে তাকিয়ে দেখি ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃত জলরাশি। কয়েক দিন আগেও ছিল কূলছাপানো পানি। এখন শুষ্ক মৌসুম। মাঝে মাঝে জেগে উঠেছে রমণীর সিঁথির মতো চিকন চর। দূর দিগন্তে ভেসে উঠেছে মেঘালয়ের পাহাড়। কয়েকজন ভ্রমণপিপাসু এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। দু-একটি বকের দেখা মিলল দূর চরে। তবে ভরা শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখিরা ছুটে আসে এখানে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীশাসন প্রকল্পের কারণে চিলমারী ব্রহ্মপুত্রের ডান তীর এখন মোটামুটি সংরক্ষিত। পিচিং করা ব্লকের সরু রাস্তা দিয়ে নদের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বন্দরের উত্তর-দক্ষিণে হেঁটে যাওয়া যায় কয়েক কিলোমিটার। চাইলে ঘণ্টা চুক্তিতে নৌকা ভাড়া নেওয়ার সুযোগও রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এখান থেকে নৌপথে রৌমারী ও রাজীবপুরে নৌকাযোগে গিয়ে মেঘালয় ও আসাম সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি এলাকা থেকেও ঘুরে আসা যায়।

এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কুড়িগ্রামের সীমান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্রের নৌপথে ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ সীমিত সংখ্যায় আসাম থেকে কলকাতায় যাতায়াত করে। নাব্যতা কমে যাওয়ায় এই পথে জাহাজ আসার সংখ্যা কমে গেছে। মাসে দু-একটির বেশি আসে না। ভারতের জাহাজগুলো মূলত এই পথে আসামের শীলঘাট থেকে চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে কলকাতা যায়। এ ছাড়া ভারত এই পথ দিয়ে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ থেকে সিমেন্ট আমদানি করে। পথটা এক হাজার কিলোমিটারের। চিলমারীতে রাজস্ব আদায়ের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি শুল্ক স্টেশন রয়েছে। জাহাজের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়ায় বন্দরে নেই কোনো কর্মমুখরতা।

এরই মধ্যে কথা হলো এলাকার কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁদের স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল করছে চিলমারী বন্দরের অতীত ঐতিহ্য। বন্দরের দক্ষিণের সোনারীপাড়ার ৯০ বছরের বৃদ্ধ সাজিমুদ্দিন। ছোট একটি দোকানের সামনে থাকা বেঞ্চে বসিয়ে বন্দরের গল্প শুনতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘চিলমারী বন্দরের স্টিমারের হুইসলের শব্দ আজও যেন কানে বাজে। একসময় কয়লার রেলগাড়ির টানা লম্বা হুইসলের শব্দে ঘুম ভাঙত চিলমারীবাসীর। ’ নদীতে স্টিমারের হুইসল, যাত্রীদের হুড়াহুড়ি, পালতোলা নৌকার মাঝিদের যাত্রী সংগ্রহের হাঁকডাক, হকারদের চিত্কার, হোটেলগুলোর চুলা ধরানোর ধুম—স্মৃতির ডালা খুলে সেসব দিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বৃদ্ধ সাজিমুদ্দিন। চলে গেলেন নিজের শৈশবে, ‘খুব কর্মচঞ্চল ছিল চিলমারী বন্দর। বড় বড় স্টিমারের আনাগোনার সঙ্গে নানা পণ্যের কারবারি-ব্যবসায়ীদের ভিড়ে মুখরিত থাকত বন্দর এলাকা। সারি বেঁধে গরুর গাড়ি চলত। চাকার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দের সঙ্গে গাড়োয়ানদের ভাওয়াইয়াগান মিলেমিশে এক অন্য ধরনের আমেজ সৃষ্টি করত। ’

চিলমারী বন্দরের পাশের ব্যাপারীপাড়ার ৮০ বছরের বৃদ্ধ খলিল মিয়াও সমর্থন করলেন বৃদ্ধ সাজিমুদ্দিনকে, ‘অত দিন আগের কথা কি আর মনে আছে সেভাবে? একসময় এই চিলমারীতেও তৈরি হতো বড় বড় জাহাজ এবং সেগুলো রপ্তানিও হতো। একসময় পাটের কারবারের জন্য বিখ্যাত ছিল কুড়িগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দর। প্রতিদিন শত শত গরুর গাড়ি করে দূর-দূরান্ত থেকে পাট আসত এখানে। ’

স্টিমার, গরুর গাড়ি, গাড়োয়ানদের গান—এখন শুধুই স্মৃতি। এখন অনেকটাই বেকার ইমদাদুল, মমিনুল ও সিরাজুলের মতো অনেক বন্দর শ্রমিক। তাদের হাতে কাজ নেই তেমন। বন্দরের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হলে অনেকেই খেটেখুটে দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করার স্বপ্ন দেখে।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি চিলমারী পর্যন্ত বাস যায়। আসাদগেট থেকে দিবা ও নৈশকালীন কোচ চলাচল করে। ট্রেনে কাউনিয়া হয়ে কুড়িগ্রাম পৌঁছে সেখান থেকে বাস বা অটোরিকশায় চিলমারী যাওয়া যায়। কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে চিলমারীর দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। সৌজন্যে : কালের কন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *