আ ন ম আমিনুর রহমান
২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ এসেছি। যে জন্য আসা সেটা হলো না। তাই সহকর্মী সদরুলসহ পরিচিত সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক সাদেককে নিয়ে হাইল হাওরের দিকে রওনা হলাম। হাঁটাপথের প্রান্তে এসে থামতে হলো। রোদ ঝলমলে সকাল, চমৎকার আবহাওয়া। কিন্তু বাতাসটা একটু বেশি। হাঁটছি আর আশপাশে পাখি খুঁজছি। পুরো হাওরজুড়ে যেন বকের মেলা বসেছে। নানা রকমের বক। আরও আছে ছোট পানকৌড়ির বড় ঝাঁক। আকাশে উড়ছে ভুবন ও শঙ্খচিল। কচুরিপানা, টোপাপানা, শাপলা ও জলজ আগাছার ফাঁক থেকে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে জলমুরগি। রাস্তার দুই পাশের ছোট ছোট গাছের ওপর উড়ছে নানা বর্ণের প্রজাপতি ও ফড়িং, মাঝে মাঝে ফুলের ওপর বসছে। একটা চিলু সাপ ব্যাঙ মুখে দৌড়ে পালাল। চমৎকার সব দৃশ্য।
আমরা দুজন হাঁটছি তো হাঁটছি, আর খুঁজছি প্রাকৃতিক পদ্ম ফুলের বাগান, যেখানে দেখা মিলবে দুর্লভ লম্বালেজি অনিন্দ্য সুন্দর এক পাখির। প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হাঁটার পর একজন বললেন, কিছুটা এগিয়ে নৌকা নিলেই পদ্ম বাগানের দেখা পাব। কাছাকাছি যেতেই নৌকা পেলাম। হাওরে প্রবল বাতাস বইছে, মাঝি ঠিকমতো নৌকা চালাতে পারছিলেন না। যা হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাকৃতিক পদ্ম বাগানে পৌঁছে গেলাম। আর মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর এক জোড়া লম্বালেজি পাখিকে পদ্মপাতার ওপর দিয়ে দৌড়ে চলে যেতে দেখলাম। একেবারে যেন জলের ময়ূর। খানিক পরে আরও কয়েকটির দেখা মিলল।
লম্বালেজি পাখিটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি ‘জলময়ূর’। নেউ, নেউপিপি, পদ্মপিপি বা মেওয়া নামেও পরিচিত। জ্যাকানিডি পরিবারভুক্ত পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম হাইড্রোফ্যাসিয়ানাস ছিররুরগাস।
প্রজননকালে জলময়ূর, বিশেষ করে স্ত্রী অত্যন্ত সুন্দর হয়ে ওঠে। এ সময় ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা লেজসহ দৈর্ঘ্যে পাখিটি ৩৯-৫৮ সেন্টিমিটার হয়। ওজনে পুরুষ সচরাচর ১১৩-১৩৫ এবং স্ত্রী ২০৫-২৬০ গ্রাম। ঘাড় সোনালি-হলুদ, পিঠ গাঢ় বাদামি, বুক-পেট কালচে-বাদামি ও লেজ কালচে। একটি কালচে-খয়েরি রেখা মাথা ও ঘাড়-গলার সাদা ও সোনালি-হলুদ রংকে পৃথক করেছে। ঠোঁট নীলচে, চোখ বাদামি ও পা নীলাভ-কালো। প্রজননকাল ছাড়া অন্য সময়ে লেজ মাত্র ১১-১২ সেন্টিমিটার।
জলময়ূর হাওর, বিল, হ্রদ প্রভৃতি মিঠাপানির জলাভূমিতে বাস করে। দেশের প্রায় সব বিভাগেই এর দেখা মেলে। গ্রীষ্মকালে একাকী বা জোড়ায় ও শীতকালে ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করে। ভাসমান পাতার ওপর হেঁটে হেঁটে জলজ উদ্ভিদে থাকা পোকমাকড় খায়। এ ছাড়া জলজ উদ্ভিদের কচি পাতা, অঙ্কুর ও বীজ খেয়ে থাকে। সচরাচর ওড়ার সময় করুণ সুরে ‘নে-উ-ইউ, নে-উ-ইউ, নে-উ-ইউ…’ ডাকতে থাকে।
মে থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। স্ত্রী সচরাচর একাধিক পুরুষের সঙ্গে প্রজনন করে। পুরুষ শাপলা ও পদ্ম পাতা বা এজাতীয় ভাসমান কোনো উদ্ভিদের পাতার ওপর বাসা বানায়। স্ত্রী তাতে চারটি জলপাই-বাদামি চকচকে ডিম পেড়ে চলে যায়। পুরুষ একাই ডিমে ২৩-২৬ দিন তা দিয়ে বাচ্চা তোলে। বাচ্চারা বেশ ইঁচড়ে পাকা হয়। ডিম থেকে ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই এরা হাঁটতে, সাঁতার কাটতে ও ডুব দিতে পারে। প্রায় দুই মাস পর্যন্ত বাবার তত্ত্বাবধানে থেকে খাবার খায় এবং জীবনধারণ করে। স্ত্রী সন্তান পালনের কাজ না করলেও নিজেদের সীমানা থেকে শত্রু তাড়িয়ে বাচ্চাদের নিরাপদে রাখতে সাহায্য করে। সুন্দর এই জলময়ূরগুলো এ দেশে বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। সূত্র : প্রথম আলো