Skip to content

হাওরের নীল জলে…

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
ঋতু পরিবর্তনে এখন বইছে শীতের হাওয়া। প্রকৃতির সৌন্দর্য সব সময়ই মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে। প্রকৃতির মাঝে একটু ডুবে যেতে পারলে আমাদের যান্ত্রিক জীবন যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। আর প্রাকৃতিক নিসর্গের মধ্যে হাওরের নান্দনিকতাটা মনে হয় একটু বেশিই থাকে। আর শীত মৌসুম এলেই বদলে যায় মৌলভীবাজরের শ্রীমঙ্গল হাইল হাওরের রূপবৈচিত্র্য। একটু উষ্ণতার জন্য শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি এসে আশ্রয় নেয় এই হাওরে। অতিথি পাখির কলরবে হাওরজুড়ে সৃষ্টি হয় এক মধুময় আবহের। পড়ন্ত বিকেলে রাথালিয়ারা গরু নিয়ে বাড়ি ফিরে। জেলেরা মাছ ধরা শেষ করে পাড়ে নৌকা ভিড়ায়। আরাব আরেক দল জেলে রাতের বেলায় মাছ আহরণের জন্য ছুটে চলে হাওরের পানে। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যের রশ্মিতে লাল হয়ে যায় হাওরের জলাশয়। শ্রীমঙ্গল হাইল হাওরের এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন পর্যটকরা। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা লেগেই আছে এই হাইল হাওরে। পর্যটকরা নৌকায় চরে ভেসে বেড়াচ্ছেন হাওরের নীল জলে।

Tanguar4

অবস্থান : প্রকৃতির সৌন্দর্য সব সময়ই মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে দিগন্তজোড়া এই হাইল হাওরের অবস্থান।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : হাইল হাওরের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৮২৪ সালে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পে পরিবর্তিত হয় সিলেটের ভূ-অবস্থান। এ কারণে শ্রীমঙ্গলের মতিগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজারের কালিয়ারগাঁও পর্যন্ত নিম্নাঞ্চল দেবে গিয়ে হাইল হাওরের সৃষ্টি হয়। ২০০৩ সালের ১ জুলাই সরকারিভাবে এই হাইল হাওরের ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাশয় বাইক্কা বিলকে মাছের স্থায়ী অভয়াশ্রম হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে বিলটি মাছের সঙ্গে সঙ্গে দেশি-বিদেশি পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। বর্তমানে হাইল হাওরের বাইক্কা বিল বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পশুসম্পদ ও মৎস্য মন্ত্রণালয় এবং ক্রেইলের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে।

কীভাবে যাবেন : শ্রীমঙ্গলের সঙ্গে সারা দেশের রেল ও সড়কপথে রয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিদিন ঢাকা থেকে তিনটি, চট্টগ্রাম থেকে দুটি আন্তঃনগর ট্রেনযোগে শ্রীমঙ্গল আসতে পারেন। এ ছাড়া দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পঞ্চগড়, টাঙ্গাইল ও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সরাসরি বাসে করে শ্রীমঙ্গল আসা যাবে। এ ছাড়া দেশের অনান্য স্থান থেকে ঢাকায় এসে সায়েদাবাদ বাস ট্রার্মিনাল থেকে হানিফ বা শ্যামলী বাসে করে শ্রীমঙ্গল আসবেন। শহর থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটারের পথ। ভাড়া করা সিএনজি অটোরিকশা, জিপগাড়ি কিংবা মোটর বাইকে করে যেতে পারেন হাইল হাওরে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবেন হাইল হাওরে।

Tanguar3

কোথায় থাকবেন : হাওর ভ্রমণ করে এসে পর্যটকরা শ্রীমঙ্গল শহরে এসে থাকতে পারবেন। শ্রীমঙ্গলে ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়েকটি হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টহাউস, কটেজ গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া শহরে হোটেল সন্ধ্যা, হোটেল আল-রহমান, হোটেল মুক্তা, হোটেল টি টাউন, হোটেল মহসীন প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে স্বল্প ভাড়ায় রাতযাপন করা যাবে।

খাওয়া-দাওয়া : শ্রীমঙ্গলে রয়েছে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। পরিষ্কার-পরিছন্ন ও একটু ভালোমানের খাবার খেতে হলে আপনাকে অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে যেতে হবে। সেখানে বাঙালি খাবারের সঙ্গে চাইনিজ খাবারও পাবেন। এ ছাড়া স্বল্প মূল্যে খাবারের জন্য ও শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক রেস্টুরেন্ট চোখে পড়বে।

কী কী দেখবেন : পুরো হাওরটি অনেকগুলো বিলে ভাগ হয়ে যায়। তখন শুধু বিলেই পানি থাকে। তবে বর্ষাকালে এই হাওর যেন এক বিশাল সমুদ্র। আর সেই সমুদ্রের উত্তর পাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মেঘালয়ের বিশাল পাহাড়। জলজ উদ্ভিদ, লতাগুল্ম ও তৃণলতায় ভরপুর হাইল হাওরের প্রাকৃতির সৌন্দর্য ছাড়াও দেখা যাবে সুদূর সাইবেরিয়াসহ হিমালয় অঞ্চল থেকে আসা শীতের অতিথি পাখি। শীতকালে এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি ভিড় জমায়। রয়েছে অনেক দেশি পাখিও। নিয়মিত দেখা যায় পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, বালিহাঁস, শঙ্খচিল, বিভিন্ন প্রজাতির বক, সারস, পাতি কুট, সরালি হাঁস, ডাহুক ইত্যাদি। এ ছাড়া অন্যান্য বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই হাওর।

Tanguar2

এ বছর হাওরে এসেছে ৩৮ প্রজাতির ৮ হাজার ৮৩২টি পাখি। হাইল হাওরের আসল সৌন্দর্য হলো এখানকার পাখি। বহুদিন ধরেই এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছে। বারো মাসই হাইল হাওর মুখরিত থাকে পাখির কলতানে। আর এই কলতান বছরের যে কোনো সময়কে ছাড়িয়ে যায় শীতকালে। এ সময় স্থানীয় পাখির পাশাপাশি অসংখ্য প্রজাতির পাখি এসে ভিড় জমায় এখানে। হাইল হাওরের একটা অংশে বেশকিছু ছন জাতীয় গাছ রয়েছে। এসব গাছের আড়ালে পাখিরা ডিম পাড়ে। যারা এখানে বেড়াতে যান তারা নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব থেকে পাখি কিংবা পাখির বাসা দেখতে পাবেন। পাখিদের জলকেলি আর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পর্যটকদের জন্য সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এই টাওয়ারে বসে পর্যটকরা বাইনোকুলার ও টেলিস্কোপ দিয়ে খুব সহজেই হাইল হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করেন। তা ছাড়া নৌকায় চড়ে বাইক্কাবিলের নান্দনিক দৃশ্য আবলোকন করার সুযোগ রয়েছে। খুব কাছ থেকে পাখির কলরব শোনার জন্য হাইল হাওরের হিজল বনের ভিতর দিয়ে খালে পাড়ে ৭ কিলো মিটার ট্রেইল নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পর্যটকদের জন্য বাইক্কা বিলে একটি ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেন্টারে আছে তথ্যকেন্দ্র, অ্যাক্যুরিয়াম ও ডিসপ্লে বোর্ড।

Tanguar

স্থানীয় লোকজনের কাছে এ হাওরটি লতাপাতার হাওর নামেই পরিচিত। কারণ এখানে প্রচুর লতা এবং গুল্মজাতীয় গাছ রয়েছে। হাওরের চারপাশে হাজার হাজার মত্স্যজীবীর মাছ আহরণের দৃশ্য অত্যন্ত মোহনীয়। বিকালের হাইল হাওর থাকে যেন পাখিদের দখলে। সন্ধ্যায় হাইল হাওরে ভ্রমণ করলে মনে হবে সারা রাত কাটিয়ে দেই পাখিদের এ রাজ্যে।

প্রবেশ ফি : ২০০৭ সাল থেকে বইক্কা বিলে প্রবেশ ফি চালু করা হয়েছে। দেশি পর্যটকের জন্য প্রবেশ ফি ১০ টাকা। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠতে ২০ টাকা। আর বিদেশি পর্যটকের জন্য ২ ইউএস ডলার (১৫০) টাকা লাগবে।

নিরাপত্তা : পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য শ্রীমঙ্গলে রয়েছে পর্যটন পুলিশ। এ ছাড়া রয়েছে ইকো ট্যুর গাইডরা। হাওর ঘুরে দেখানোর জন্য ইকো ট্যুর গাইডদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন। সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *