Skip to content

হাটিকুমরুল মন্দিরে

রেজাউল করিম নোমান
যমুনা নদী পার হতেই গত রাতে দেখা ম্যাপ যেন চোখে ভেসে উঠল। সিরাজগঞ্জে কয়েকবার এলেও হাটিকুমরুল আসা হয়নি আগে। ম্যাপ দেখে যতটুকু বুঝেছিলাম, সেভাবে বাস থেকে নেমে পড়লাম কড্ডার মোড়। কিন্তু তার পরই জানতে পারলাম মন্দিরের অবস্থান শহর থেকে বেশ দূরে। অগত্যা এবার একটি লোকাল বাসে চড়ে বসলাম। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার সেই বাস জার্নিটা ছিল মনে রাখার মতো। মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পথের সঙ্গে এই সময় হিসাব করলে সহজেই যে কেউ বের করে ফেলতে পারবেন সেই বাস কতটুকু পর পর থেমেছে, আর কোন গতিতে চলেছে।

Hatikumrul

অবশেষে নামলাম সিরাজগঞ্জ রোডে। ওটা একটা চৌরাস্তার মোড়। একটা পথ পাবনা, একটা রাজশাহী হয়ে আরো উত্তরে, বাকি দুটো রাস্তা গেছে বগুড়া ও পঞ্চগড়ের দিকে। ঢাকা থেকে আসা রাস্তাটা মোড় স্পর্শ না করতেই একটা ড্রিংকসের পাইকারি দোকান। মাঝবয়সী এক লোক টেবিলে চোখ নামিয়ে ডিজিট ওঠা একটা ক্যালকুলেটরে কিছু একটা হিসাব কষছিলেন। চোখ তুলতেই জানতে চাইলাম, হাটিকুমরুল কি পেছনে ফেলে এসেছি? বাস থেকে একটা সাইনবোর্ডে হাটিকুমরুল লেখা দেখে এই প্রশ্ন। লোকটা বলল, না। তারপর বলল, কই যাইবেন? বললাম, মন্দির, হাটিকুমরুল মন্দির।

লোকটার দেখানো পথে মোড় ঘুরে ডানদিকে অর্থাৎ যে পথটা বগুড়ার দিকে, সে পথ ধরলাম। একটা রিকশা-ভ্যানকে জিজ্ঞেস করলাম হাটিকুমরুল মন্দির যাবে কি না? চিনল না জায়গাটা। পাশ থেকে একটা ছেলে কাছে এসে বলল, আমার সঙ্গে আসেন। ওয় চিনব না। হাটিকুমরুল হইল আমারই গেরাম, চলেন।

ওই ছেলের রিকশায় উঠে বসলাম। সামান্য এগোতেই মূল রাস্তা থেকে ডানে নেমে ঢালু মাটির রাস্তা। রাস্তার দুই পাশেই গ্রাম। মাঠজুড়ে সবজি। মাঝেমধ্যে ধানক্ষেত। পথের ডানপাশে পরপর কয়েকটা পুকুর। ছেলেটার কাছে জানতে চাইলাম মন্দিরটা নিয়ে। বিশেষ কিছুই জানে না ও। শুধু বলতে পারল, মন্দিরটা বানিয়েছে জমিদাররা।

মিনিট দশেকের পথ পেরোলেই ডানপাশে গাছপালার ফোকর দিয়ে চোখে পড়ল ছোট একটা দোচালা মন্দির। এখানে রিকশা থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম। একটু এগোতেই আরেকটা মন্দির পেলাম। দেখতে গোলাকারমতো হলেও আসলে এটা আট কোনা। গম্বুজটাও আট কোনা। গম্বুজের শীর্ষ ভাগ ধীরে ধীরে সরু হয়ে ওপরে উঠে গেছে। মন্দিরের ভেতর-বাইরের দেয়ালের প্লাস্টারে মোগল স্থাপত্যরীতির ছোঁয়া। স্থানীয় লোকদের কাছে এটা একটা শিবমন্দির। মন্দিরের কার্নিশ বাঁকানো, আর ভেতরে ছোট একটা শিবলিঙ্গ স্থাপন করা।

শিব মন্দিরের এক শ ফুট পরেই দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় মূল মন্দির, যেটা দেখতেই এত দূর ছুটে আসা। হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির।

ইতিহাসের বই ঘেঁটে প্রথম খোঁজ পেয়েছিলাম এটার। সেই সূত্রেই জেনেছি, মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলি খানের আমলে (সময়টা ১৭০৪ থেকে ১৭২৮ সাল) জনৈক রামনাথ ভাদুড়ি এটা তৈরি করেছিলেন। হিন্দু স্থাপত্যের চমৎকার নিদর্শন কারুকার্যমণ্ডিত নবরত্ন মন্দিরটা তিনতলা। এ মন্দিরে ছিল পোড়ামাটির ফলকসহ ৯টা চূড়া। তাই একে ‘নবরত্ন মন্দির’ বলা হতো।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবেই মন্দিরটাকে দেখতে আসা। খুব বেশি আশা করিনি। কিন্তু হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির দেখে রীতিমতো থ হয়ে গেলাম। গ্রামের এতটা ভেতরে, ধরতে গেলে অজপাড়া-গাঁয়ে এত সুন্দর পরিচ্ছন্ন মন্দির দেখতে পাব, ভাবাই যায় না!

দিনাজপুর জেলার কান্তজির মন্দিরের অনুকরণে তৈরি মন্দিরটা বর্গাকার। প্রায় ২ ফুট উঁচু প্লাটফর্মের ওপর তৈরি মন্দিরের মূল কক্ষটা বেশ বড়। অতীতে চার দেয়ালের বাইরের অংশটা পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সাজানো ছিল। কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক আর মানুষের অবহেলায় সব নষ্ট হলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দিরটা নতুন করে সংস্কার করেছে। এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবরত্ন মন্দির। মূল অবস্থায় মন্দিরটা পোড়ামাটির চিত্রফলক দিয়ে যে সাজানো ছিল, সেটা দেখলেই বোঝা যায়। এখনো মাটির গায়ে সামান্য কিছু চিত্রফলকের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। এই মন্দিরটার কোনো শিলালিপি বা নির্ধারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।

এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, স্থানীয়ভাবে মন্দিরটা ভাদুড়ি জমিদারদের মন্দির হিসেবেই পরিচিত। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে ধারণাটা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত সেটা হচ্ছে, মথুরার রাজা প্রাণনাথের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন জমিদার রামনাথ ভাদুড়ি। রাজা প্রাণনাথ দিনাজপুরের কান্তনগরে ঐতিহাসিক কান্তজির মন্দির নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সংকটে পড়ে যান। এতে তিনি বার্ষিক রাজস্ব পরিশোধ করতে অপারগ হয়ে পড়েন। এদিকে রামনাথ ভাদুড়ি বন্ধুত্বের খাতিরে নিজ কোষাগার থেকে অর্থ দিয়ে রাজা প্রাণনাথের বকেয়া পরিশোধ করে দেন, শর্ত ছিল দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের আদলে হাটিকুমরুলে একটা মন্দির তৈরি করে দেবেন রাজা। শর্তমতো রাজা প্রাণনাথ কান্তজির মন্দিরের অবিকল নকশায় হাটিকুমরুলের নবরত্ন মন্দির তৈরি করে দেন। আরেকটা মত হলো, রাখাল জমিদার নামে পরিচিত রামনাথ ভাদুড়ি তাঁর জমিদারি আয়ের সঞ্চিত কোষাগারের অর্থ দিয়েই এ মন্দির তৈরি করেন। সে সময় বহুকাল ধরেই মহাধুমধামে এ মন্দিরেই পূজা-অর্চনা করা হতো। কালের বিবর্তনে ভারত উপমহাদেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত, দেশ বিভাগ ও নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে হারিয়ে যায় জমিদারদের পূর্ব পুরুষরা। অরক্ষিত এ নবরত্নের অনেক মূল্যবান প্রাচীন সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায় দেশি-বিদেশি দুর্বৃত্তরা। স্বাধীনতার পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পর্যায়ক্রমে বের করে নিয়ে আসে এর পুরনো সৌন্দর্য।

ঘুরতে ঘুরতে এখানকার লোকদের সঙ্গে আরো কথা হলো। বেরিয়ে এলো আরো তথ্য। এই এলাকায় এখনো দুই-তিন মাইলজুড়ে স্থানীয় মাপে তিন-চার পুরুষ অর্থাৎ ২০-২৫ ফুট মাটি খুঁড়লে পুরনো লম্বা প্রাচীর এবং সারি সারি ইটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সম্ভবত জমিদার বাড়িটা মাটির নিচে হারিয়ে গেছে। এখানকার অধিবাসীদের ধারণা, মন্দিরগুলো জমিদারবাড়ির চেয়ে উঁচুতে ছিল অথবা দৈববলে মাটির নিচে হারিয়ে যায়নি। প্রথমেই দোচালা ছনের ঘরের আদলে যে মন্দিরটার কথা বলেছিলাম, সেটা নাট মন্দির, যা স্থানীয় লোকজনের ভাষায় বাংলা মন্দির। আট কোনা মন্দিরটা শিবমন্দির, বড় মন্দিরটা নবরত্ন মন্দির, আর নবরত্ন মন্দিরটার পেছন দিকে আরেকটু ভেতরের দিকে অলংকরণ করা আরেকটা প্রায় গোলাকার শিব মঠ। এ নিয়েই হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির এলাকা। অনেকটা সময় ঘোরা হয়ে গেছে, এবার ফেরার পালা। খুব ছিমছাম আর পরিচ্ছন্ন এলাকাটা। তাই যে কারো বেড়ানোর জন্য এটা হতে পারে এক চমৎকার জায়গা ।

কিভাবে যাবেন
ঢাকা-বগুড়ার বাসে উঠে নামবেন সিরাজগঞ্জ মোড় রোডে। তারপর ভ্যান বা রিকশায় চেপে পৌঁছে যাবেন হাটিকুমরুল মন্দিরে। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *