Skip to content

হাতিরঝিলে সারাবেলা

:: বিপাশা রায় ::
ওয়াটারবাস যখন চলতে শুরু করল, তখন গোধূলিবেলা। সন্ধ্যা নামছে হাতিরঝিলে। সেই সব ছবি ধারণে ব্যস্ত আমাদের আলোকচিত্রী। দুপাশের রাস্তায় ছুটে চলেছে গাড়ি। মাঝখানে হাতিরঝিল, গোধূলির আকাশ, দুই ধারের ঘন সবুজ—সব মিলিয়ে এই ২০ মিনিটের যাত্রাপথে দেখতে পাবেন প্রকৃতির এক মোহনীয় রূপ।

মাঝে মাঝে কাজের ব্যস্ততায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে কার না মন চায়। হাতে যদি লম্বা সময় না থাকে, তবে দূরে যাওয়ার কী দরকার? হাতের কাছেই তো হাতিরঝিল। একবার ঢুঁ মেরে আসা যায় এখান থেকে। ঝলমলে রোদ বা মেঘলা আকাশ—যেকোনো দিনেই হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছুঁয়ে যাবে মন। আর রাতের বেলায় চারদিকে আলোর ঝলকানি ও মানুষের হুল্লোড়ে সে এক অন্য হাতিরঝিল।

২০১২ সালে উদ্বোধনের পর থেকেই হাতিরঝিল ঢাকাবাসীর কাছে হয়ে উঠেছে পছন্দের একটি বিনোদনের স্থান। শুরুতেই মনোরম জলাধার আর রাস্তার দুপাশের সবুজের সমারোহ নজর কেড়েছিল সবার। সংযোগ সেতু ও সড়কগুলোর দুই ধারের রঙিন আলোই হয়ে উঠেছিল তখনকার হাতিরঝিলের মূল বিনোদন। তবে এখনকার চিত্র বদলে গেছে অনেকটাই। ২৫ অক্টোবর হাতিরঝিলে গিয়ে তেমনটাই দেখা গেল। রেস্তোরাঁ, ওয়াটারবাস, প্যাডেল বোট আর জলের মধ্যে আলোর ফোয়ারার ঝলকানিতে পুরোই জমজমাট হাতিরঝিল।

এফডিসি মোড় দিয়ে হাতিরঝিলে ঢুকতেই মগবাজার সংযোগ সেতুর পাশে রয়েছে দর্শনার্থীদের বসার স্থান। সারি সারি ইটের টেবিলে আছে দাবার বোর্ড। সকাল-সন্ধ্যা এখানে খেলায় মেতে উঠতে পারেন যে কেউ। এর কিছুটা সামনেই হাতিরঝিল বাসস্টপেজ। একটা সময় অনেক দর্শনার্থীই এই বাসে চড়ে হাতিরঝিল ঘুরে দেখতেন। তবে বিনোদনের আরও উপাদান যোগ হওয়ায় দর্শনার্থীদের চেয়ে যাত্রীদের ভিড়ই এখন বেশি। বাসস্টপেজের উল্টো দিকে এফডিসি মোড়ের ওয়াটারবাস স্টেশন। এর বিপরীতেই কাচের দেয়ালঘেরা রেস্টুরেন্ট ওয়াইওডি।

রেস্টুরেন্টের সামনে বিশাল লন, এখানে আছে খাবারের ব্যবস্থা। ভেতরের চেয়ে লনেই ভিড় বেশি। লনে ঢুকতেই দেখলাম, হইহুল্লোড়ে মেতে উঠেছে একদল তরুণ-তরুণী। কথা বলে জানা গেল, এক বন্ধুর জন্মদিন উদ্যাপন করতে এখানে এসেছে সবাই। খাবারের চেয়েও এখানকার খোলামেলা পরিবেশ নাকি ওদের বেশি টানে। এঁদেরই একজন দীপন জানালেন, এখানে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয় না। তাই এ জায়গা তাঁদের কাছে অনেক প্রিয়। ওয়াইওডিতে মিলবে চিকেন ফ্রাই, বার্গার, ফ্রায়েড রাইস ইত্যাদি।

চিকেন ফ্রাই খেয়ে ওয়াটারবাসের টিকিট কাটলাম। গন্তব্য এবার বাড্ডা। এখান থেকে বাড্ডা ছাড়াও রামপুরা আর গুলশান-১-এর উদ্দেশে ছেড়ে যায় ওয়াটারবাস। টিকিটের মূল্য যথাক্রমে ২৫ ও ৩০ টাকা। ওয়াটারবাসের লাইনে যখন দাঁড়িয়ে, তখন আরেকটি ওয়াটারবাস থেকে নামছিল শিশুদের দল। তাদের উল্লাস আর হইহুল্লোড় বুঝিয়ে দিচ্ছিল শিশুদের কাছে এই জলযান কত প্রিয়।

আমরা যখন বাড্ডার কাছাকাছি, তখন দেখতে পেলাম লেকে অনেক প্যাডেল বোটের মেলা। হংসমুখী বোটগুলোর ওপর পড়ছিল বাড্ডা-রামপুরা সংযোগ সেতুর আলো। সব মিলিয়ে মনে হলো এই প্রান্তে যেন আরও রঙিন হাতিরঝিল।

এখানে কথা হলো প্যাডেল বোটের ইনচার্জ মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে। বললেন, ২০টি প্যাডেল বোট প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এখানে চলে। প্রতি ঘণ্টার ভাড়া ২৫০ টাকা। আধা ঘণ্টা ঘুরতে চাইলে খরচ পড়বে ১৫০ টাকা। প্রতিটি নৌকাতেই আছে লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা।

বাসস্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। এই প্রান্তেও রয়েছে ওয়াইওডির মতো একই আদলে তৈরি রেস্তোরাঁ এসওডি। খাবারের মেন্যু এবং দামটাও প্রায় একই। এখানকার ব্যবস্থাপক এম আবুল কাশেম বললেন, ‘বিয়ে ছাড়া এখানে যেকোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে ।’

রেস্তোরাঁয় কোমল পানীয় খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন বাড্ডা থেকে রামপুরায় আসছিলাম, তখন কানে ভেসে এল গানের সুর। ঝিলের এপাশে খোলা পরিসরে ঘাসের ওপর বসার ব্যবস্থা আছে। সেখানেই গিটার হাতে গান আর আড্ডায় ব্যস্ত তরুণেরা। ঘুরে বেড়ানো আর আড্ডা কি ফুচকা ছাড়া জমে? তাই ভেবেই কিনা জানি না বাড্ডা-রামপুরা সংযোগ সেতুর পাশেই রয়েছে ফুচকার এক জম্পেশ আয়োজন। খেতে চাইলে বেশ কিছুটা সময় দাঁড়াতে হবে লাইনে। এবার ফেরার পালা। রামপুরা ওয়াটারবাস স্টেশন থেকে ফিরতি পথের যাত্রা। রাত তখন সাড়ে ৭টা। একই পথে যাচ্ছি, তবে এই অনুভূতি অন্য রকম। নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে ওয়াটারবাসের ভেতরের আলো। বাসের বাইরে জ্বলছে শুধু মরিচ বাতি। হাতিরঝিলের সংযোগ সেতুগুলোর আলোও ঝলসে পড়ছে পানিতে, অন্ধকারে সৃষ্টি হচ্ছে রঙের আবহ। আমরা যখন গুলশানের কাছাকাছি, তখনই সবাইকে চমকে দিয়ে নেচে উঠল আলোর ফোয়ারা। অন্ধকারে হঠাৎ এই আলোর রোশনাই সবার চোখে-মুখে ছড়িয়ে দিচ্ছিল খুশির ঝলক। মনে হচ্ছিল, এ যেন আলোর ফোয়ারা নয়, যেন নগরবাসীর একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার আনন্দ। সৌজন্যে: প্রথম আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *