Skip to content

হাতির দেশে কয়েক দিন

: : ফাহমিদা আখতার : :

হঠাৎ করেই বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়া অনেক দিন পর, প্রায় ৫ বছর। দেশের সীমানার বাইরের যাওয়ার উত্তেজনা অন্যরকম। ভিসা পাওয়ার পর থেকেই ক্ষণ গণনা। ক্ষুদে ট্যুরিস্ট ফিদেলের নানা প্রশ্ন চলতে থাকে সফর শুরু পর্যন্ত। ভিসা পেতে পেতে থাই এয়ারওয়েজের টিকিট শেষ! বিমানই ভরসা। যাত্রার জন্য বিমান প্রথম পছন্দ না হওয়া যৌক্তিক মনে হয় সফরের শেষ দিনে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ৩০ আগস্ট সকাল সাড়ে এগারটায় যাত্রার সময়। সহযাত্রী মা-ছেলে বাসা থেকে রওনা করলাম সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে। সোয়া ৮টা নাগাদ শাহজালাল বিমানবন্দরে। সোয়া ৯টার মধ্যে ইমিগ্রেশনের ফরমালিটি সম্পন্ন। এবার বোর্ডিং এর অপেক্ষা। ফিদেল ৫ মিনিট পর পর মনিটরে দেখে আসছে আমাদের বোর্ডিং কোন গেইটে। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে বিমান টেক অফ করতে করতে অতিরিক্ত প্রায় দেড় ঘন্টা সময় পার হয়ে গেলো। সোয়া দু’ঘন্টা ওড়ার পর নামলাম ব্যাংককের সুবর্নভূমি এয়ারপোর্টে। নামার সময় চোখে পড়লো সর্পিল চার-পাঁচতলা রাস্তা। সেসব রাস্তা দিয়ে দুর্দান্ত গতিতে চলেছে আধুনিক সব গাড়ি। ইমিগ্রেশনের ফরমালিটি শেষ করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই পেলাম ফিদেলের বাবাবে। যিনি আমাদের আগেই অফিসিয়াল সফরে ব্যাংককে ছিলেন। তিনি আমাদের রিসিভ করে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন।

হোটেলের পথে আমাদের চোখ গাড়ির জানালায়। ধূলাবালির চিহ্ন নেই কোথাও। গাছপালা খুব বেশী চোখে পড়ে না। একেবারে কম তাও নয়। দীর্ঘকায় সব ফ্লাইওভার দিয়ে চলার পথে গাছপালা খুব বেশী চোখে পড়ার কথাও নয়। কারণ ওগুলোর উচ্চতা গাছেদের চেয়ে বেশী। মাইলের পর মাইল সাদা কাঠগোলাপ চোখে পড়ার মতো। অপরিচিত গাছও আছে। ছাতিম, বাগান বিলাস, কাঠবাদামও আছে। রাস্তায় চলতে সবচেয়ে আরামের বিষয়, কান ঝালাপালা করা কোন শব্দ নেই। যেটা ঢাকা শহরে থাকা অবস্থায় কল্পনা করাও অসম্ভব। গাড়ি চালকরা সচারাচর রাস্তার লেনও পরিবর্তন করেন না। হাইওয়েতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিবেগ ৮০ কিলোমিটার। রাস্তা ফাঁকা থাকলেও গতি বাড়ানো অপরাধ। আর ব্যাংককে হাইওয়ে পুলিশ খুব সক্রিয়। নিয়ম ভাঙ্গলেই জরিমানা। এসব জেনেছি পরে, আমাদের ট্যুর গাইডের কাছ থেকে।

হাইওয়ে থেকে নেমে ব্যাংককের রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ে বহুতল সব আধুনিক ভবন। আমি ভবন দেখি আর ফিদেল দেখে লেটেস্ট মডেলের সব গাড়ি। তার পছন্দের একেকটা গাড়ি পাশ দিয়ে যায় আর সে চিৎকার করে ওঠে। শহরের অবকাঠামো দেখে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের কথা মনে পড়ে। দুটি শহরের মধ্যে অবকাঠামোর দিক দিয়ে অনেক মিল! রাস্তায় চলতে চলতে চোখে পড়ে স্ট্রিটফুডের ভ্যানগুলো। ঢাকায় থেকেই যেসব খাবারের গল্প শুনে এসেছি। এবার সেগুলোর স্বাদ নেবার পালা। হোটেলে ঢোকার মুখে পার হলাম বিখ্যাত সেই বামব্রুনগ্রাদ হাসপাতাল।

সুকুম্ভিতের ‘নানা’ এলাকায় হোটেল ‘ওমনি টাওয়া’রে নিজেদের রুমে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় সন্ধ্যা। ফ্রেশ হয়ে বের হলাম আর্লি ডিনারের উদ্দেশ্যে। ব্যাংককে গলির রাস্তাগুলোকে ওরা বলে সয়া। আমরা ছিলাম সয়া ৪ এ। ডিনারের জন্য গেলাম সয়া ১১ তে, সজলের পছন্দের একটা রেস্টুরেন্টে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সবচেয়ে চোখে পড়ে ভারতীয় নাগরিকদের। তারা ছাড়া আছে ইউরোপিয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে যেয়ে কিছুটা বিব্রতও হচ্ছিলাম। রাত আটটায় ঢাকায় প্রায় সন্ধ্যা হলেও ওদের ওখানে একই সময়ে নাইট লাইফ শুরু হয়ে যায়। ট্যুরিস্ট এলাকায় রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ে চড়া মেকআপের খোলামেলা পোশাকের হাস্যোজ্জল নারীদের। এদের অনেকে স্থানীয় বাসিন্দা। কৃষ্ণাঙ্গ আকর্ষণীয় নারীদের সংখ্যাও কম না। রাস্তার পাশের বার/পাবগুলো থেকে হাই ভলিউমের মিউজিকের মূর্ছণাও কানে আসে।
ব্যাংককের সাফারি ওয়ার্ল্ডে সিংহদের অলস সময়

যা হোক রেস্টুরেন্টে আমরা ভাতের সঙ্গে খেলাম স্টিমড কোরাল, ফিদেল নিলো পিজ্জা। আস্ত কোরালটি দুজনের জন্য পরিমাণে একটু বেশীই ছিলো। ফিদেলও তার পিজ্জা শেষ করতে পারেনি। খোলা আকাশের নীচে আলো-আধারীতে বসে লাইভ সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডিনার চললো।হোটেলে ফিরে আর্লি ঘুম দিলাম। সকাল থেকে আমাদের মূল বেড়ানো শুরু হবে। হোটেলেই নাস্তা সেরে আমরা সাড়ে আটটায় রওনা করবো।

পরিকল্পনামতো ঠিক সাড়ে আটটায় আমরা লবিতে পেলাম ট্যুর গাইড জেনিকে। তার সঙ্গে সজলের আগেই বেড়ানোর পরিকল্পনা ঠিকঠাক করা ছিলো। জেনি খুব হাসিখুশি এক মহিলা। ফিদেলকে দেখে আপ্লুত। জেনির ব্যক্তিগত গাড়ীতেই আমরা রওনা করলাম সাফারি ওয়ার্ল্ডের উদ্দেশ্যে। সেখানে আমারা সারাদিন কাটাবো।
অবসর সময়ে কুমির

সাফারি ওয়ার্ল্ড:
ব্যাংককে ক্ষুদে টুরিস্টদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা এই সাফারি ওয়ার্ল্ড। এটি চিড়িয়াখানার আধুনিক রূপ। এখানে সারা বিশ্ব থেকে আনা নানা প্রজাতির প্রাণী আছে। আছে জলজ প্রাণীও। এখানে উন্মুক্ত ভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে রযেল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, ভালুক, জিরাফ, জেব্রা, জলহস্তী, হরিণ আর নানা প্রজাতির হাজার হাজার পাখি। গাছের উপর আর জলাশয়ে চষে বেড়াচ্ছে তারা। ভয়ঙ্কর প্রাণীদের খুব কাছ থেকে দেখার ব্যবস্থাও আছে। উন্মুক্ত ভূমির ভেতর দিয়ে গাড়ীতে করে যাওয়ার অনুমতি মেলে। ক্ষুদে টুরিস্টদের জন্য এখানে আছে বিভিন্ন প্রাণীর শো। সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত চলে নানা শো। এসব শো আমরা ছোটবেলায় টিভিতে সার্কাস হিসেবে দেখেছি।

সাফারি ওয়ার্ল্ডে ঢোকার সময় চোখে পড়লো ইউনিফর্ম পরা কয়েকশ বাচ্চা। এদের বয়স ৩/৪ বছর হবে। স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে লাইন ধরে ঢুকছে সাফারি ওয়ার্ল্ডে। কয়েকটি স্কুলের বাচ্চাদের দেখা গেলো সেখানে। সকাল ১০.২০ এ শুরু ওরাংওটাং শো। বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে শো এর গ্যালারির সিট দখল করতে। তাদের সঙ্গে আমাদেরও দৌড় শুরু। বাচ্চারা দারুণ উপভোগ করলো দুই ওরাংওটাং এর রেসলিং। রেসলিং এর আগে পরে শো’তে অংশ নিলো প্রায় ৫০টি ওরাংওটাং। বেশ উপভোগ্য সেই উপস্থাপনা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই বানরগুলোকে প্রশিক্ষিত করতে কত সময় আর শ্রম দিতে হয়েছে এদের প্রশিক্ষকদের! শো এর পর ছিলো বানরগুলোর সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ। তবে প্রতিটি ছবির জন্য গুনতে হবে চারশ’ বাথ।

এরপর জিরাফদের দর্শনের পালা। নিরীহ এ প্রাণীগুলো মানুষ দেখলেই কাছে এগিয়ে আসে। তাদের খাবার দেয়ার জন্য লাগবে একশ বাথ। ট্যুরিস্টদের অর্থেই প্রাণীদের খাবার খাওয়ানো চলছে। ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো, ব্যবসাটাকে এরা খুব ভালোভাবে ধাতস্ত করেছে। মাছকে খাওয়াতে লাগে ৫০ বাথ।

ওরাংওটাং এর পর ছিলো ‘সি লায়ন’ সিল মাছেদের প্রদর্শনী। তারপর হাতিদের ক্যারিশমা। প্রতিটি শোতেই ছিলো উপচে পড়া ভীড়। বাচ্চারা কী পরিমাণ উপভোগ করেছে না দেখলে বিশ্বাস করার নয়। হাতীদের শো এর পর লাঞ্চের বিরতি। ওখানকার টিকেটেই রয়েছে লাঞ্চের ব্যাবস্থা। লাঞ্চ দু’রকম। ইন্ডিয়ান এবং থাই খাবার সরবরাহ করা হয় সেখানে। আমরা খেলাম ইন্ডিয়ান খাবার। খাবারের মেনু যাই হোক না কেন সব খাবারেই রয়েছে কমন একটা স্মেল। এটা কীসের স্মেল না বোঝা না গেলেও সমুদ্রের নোনা স্বাদের সঙ্গে এর মিল রয়েছে।

লাঞ্চের পর ডলফিন শো, এবং ওয়ার (যুদ্ধ) শো। আমার কাছে ডলফিন শো সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগলেও ফিদেল পছন্দ করলো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। যদিও প্রায় পুরো সময় সে হাত দিয়ে কান বন্ধ করে রাখলো। আশেপাশে আরো দুএকটা বাচ্চা পাওয়া গেলো যারা ফিদেলের মতো সাহসী (ভীতু)!

সবগুলো শো শেষ হতে হতে বেলা পড়ে আসলো। ‘বার্ড শো’ বাদ দিয়ে আমরা গেলাম বন্য প্রাণীদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। জেনির গাড়ী চেপে তাদের ডেরায় প্রবেশ করলাম। ঢোকার পথেই সতর্ক বার্তায় লেখা রয়েছে: গাড়ীর ভেতরে অবস্থান করো, দরজা/জানালা খোলা যাবে না কিছুতেই। নির্দেশনা মেনে আমরা এগিয়ে চললাম। শুরুতেই পাখিদের রাজ্য। তাদের অভয়ারন্যে নির্বিঘ্ন তাদের চলাফেরা। সারস পাখিই বেশী। অন্য প্রজাতির অনেক পাখিও রয়েছে। জেনি বললো এই পাখিদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। এরা এই জায়গা ছেড়ে যায় না। একটা সারস পাখি তো আমাদের রাস্তা আটকে দিলো। আয়েশি ভঙ্গিতে রাস্তা পার হলো প্রায় ২ মিনিট সময় নিয়ে। ততোক্ষণ আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলো।
তিনি রাস্তা পার হচ্ছেন!

পাখিদের পর বনগাই আর হরিণদের আস্তানা। এর পরেই রয়েছেন বাঘ মামারা। জেনি জানতো না এই বাঘ মামাদের আনা হয়েছে আমাদের সুন্দরবন থেকে। গল্পে গল্পে জেনিকে আমরা জানালাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু, সুন্দরবন আমাদের জাতীয় বনভূমি। কথা প্রসঙ্গে জানা গেলো থাইল্যান্ডের জাতীয় পশু হাতি। তাদের পোশাক, আসবাব, ব্যবহৃত অন্যান্য সবকিছুতে হাতীর প্রতীকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন সকালে গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করে প্রার্থণা দিয়ে তারা দিন শুরু করে। এরপর গুরুত্বপূর্ণ হলেন তাদের রাজা। সৌজন্য : চ্যানেল আই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *