জসীম পারভেজ, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
ছয়টি লক্ষ্মীপেঁচার ছানার জীবন রক্ষা করে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে থেমে থাকেননি হান্নান খান। এখন তিনি বিলুপ্তির পথে হাঁটা পেঁচার বংশ বাড়াতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। লক্ষ্মীপেঁচার অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের গৈয়াতলা গ্রামের বাড়ির পাশেই মাটির কিল্লায় নিয়েছেন বিশেষ ব্যবস্থা। তালগাছ, খেজুরগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ঘেরা নির্জন কিল্লায় লক্ষ্মীপেঁচাকে ডিম দেওয়ার জন্য কিছু মরা তালগাছ অক্ষত অবস্থায় রেখেছিলেন তিনি। সেই তালগাছের কোটরে লক্ষ্মীপেঁচা ডিম দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছে। এতেই হান্নান খানের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। দিন-রাত পাহারা দিচ্ছেন বাচ্চাগুলোকে তাদের মায়ের ভালোবাসা ও খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে অক্ষত অবস্থায় বড় হওয়ার জন্য।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের গৈয়াতলা গ্রামের হান্নান খানের বাড়ির একটি মরা তালগাছের কোটরে জন্ম নেয়া লক্ষ্মীপেঁচার দল।
সরেজমিন নীলগঞ্জের গৈয়াতলা গ্রামের মাটির কিল্লায় গিয়ে দেখা গেছে, হান্নান খান মাটির কিল্লা থেকে ১০০ গজ দূরে এক খণ্ড মাটির স্তূপের ওপর বসে এক ধ্যানে একটি মরা তালগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাছে পৌঁছাতেই হান্নান খান আচমকা লাফিয়ে উঠে এই প্রতিবেদককে বুকি জড়িয়ে ধরলেন। কুশল বিনিময়ের পরই বলে উঠলেন, ‘আজই আপনাকে ফোনে এখানে আমন্ত্রণ জানাতাম। কেননা ওই যে মরা তালগাছ দেখছেন, ওখানে এবারও লক্ষ্মীপেঁচা ডিম দিয়ে ৮-৯টি বাচ্চা ফুটিয়েছে। আমি সার্থক হয়েছি ওদের ডিম পাড়ার জন্য নিরাপদ স্থান গড়ে তোলার জন্য। আমি লক্ষ্মীপেঁচা রক্ষা করার জন্য ২০১৪ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নিই। সেই থেকে আমি বিলুপ্ত প্রজাতির এই লক্ষ্মীপেঁচার বংশ বিস্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
হান্নান খান জানান, ডিসেম্বরে লক্ষ্মীপেঁচা যুগল ওই তালগাছের কোটরে ডিম দিয়েছিল। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ডিম ফুটে ৯টি বাচ্চাও জন্ম নিয়েছে। বাচ্চাগুলোর মধ্যে দু-একটি বড়-ছোট রয়েছে। মরা তালগাছটির কাছে গিয়ে দেখা যায়, তালগাছের গোড়ায় নতুন মাটি দিয়ে গাছটিকে মজবুত করে রাখা হয়েছে। গাছটির একটি ছিদ্র দিয়ে কোটরের ভেতর ক্যামেরা তাক করতেই বাচ্চাগুলো ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলছে প্রচণ্ডভাবে। ছবি তুলতেই দেখা গেল দূরের একটি চাম্বলগাছের মগডালে বসে একটি লক্ষ্মীপেঁচা উঁকি-ঝুঁকি মারছে।
হান্নান খান আরো জানান, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর আমার বাড়ির নির্জন মাটির কিল্লার মরা তালগাছের কোটরে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটিয়েছে লক্ষ্মীপেঁচা। এখন মনে হচ্ছে পুরো নীলগঞ্জ ইউনিয়নটি লক্ষ্মীপেঁচার নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে চলছে। প্রথমে আমার বাড়ির কিল্লার তালগাছের কোটরে লক্ষ্মীপেঁচার ছয়টি বাচ্চা হয়। সব বাচ্চা বড় হতে সহায়তা করে উড়ে যেতে সুযোগ করে দেওয়ার পর ২০১৪ সালে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মস্তফাপুর গ্রামের আনোয়ার শরীফের বাড়ির মরা তালগাছের কোটরে আটটি বাচ্চা দেয়, ২০১৫ সালে গৈয়াতলা গ্রামের সোনাতলা নদীর তীরে একটি কেওড়াগাছের কোটরে পাঁচ-সাতটি বাচ্চা ফোটায় পেঁচা। বাচ্চাগুলো রক্ষার জন্য সবখানেই ছুটে গিয়েছি। সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন করে বাচ্চাগুলো রক্ষার চেষ্টা করেছি। আবারও এখন আমার বাড়ির কাছে মরা তালগাছের কোটরে ডিম দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছে। সাধারণত লক্ষ্মীপেঁচা প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।
এ বছর হান্নান খানের সঙ্গে ৯টি লক্ষ্মীপেঁচা রক্ষার কাজে সহযোগিতা করছে একই গ্রামের আরিফ বিল্লাহ, রাকিবুল ইসলাম ও ইব্রাহীম মৃধা।
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম বলেন, লক্ষ্মীপেঁচার জাতটি বিলুপ্তির পথে। পেঁচা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পরিবেশবান্ধব লক্ষ্মীপেঁচা অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। লক্ষ্মীপেঁচার বৈজ্ঞানিক নাম ঞুঃড় ধষনধ (টাইটো আলবা)। ইংরেজি নাম হচ্ছে ইধত্হ ডড়ষ (বার্ন আউল)। বাংলাদেশে এটি লক্ষ্মীপেঁচা নামে সবার কাছে পরিচিত। এগুলো স্তন্যপায়ী প্রাণী ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। এই বিলুপ্ত প্রজাতির পেঁচা রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা উচিত। সূত্র : কালের কণ্ঠ