Skip to content

হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যা অ্যানাস্তাসিয়া

Anasthasia

তানভীর আহমেদ
রাজপুত্রের প্রত্যাশা ছিল রাজার। অথচ রানীর কোলে এলো রাজকন্যা। রাজকীয় বিলাস তাই কপালে জোটেনি তার। তবে কৈশোরেই নিজের কর্মগুণে নজর কেড়েছিল সে। যুদ্ধক্লান্ত রাজ্য। রাজপরিবারের সদস্যরা ধরা পড়লেন শত্রুপক্ষের হাতে। সবাইকে হত্যা করা হলেও কেউ কেউ দাবি করলেন— রাজকন্যা পালাতে সক্ষম হয়েছে! কথিত মৃত্যুর পরও অনেকে দাবি করতে শুরু করলেন— আমিই হারানো রাজকন্যা!

নাম তার অ্যানাস্তাসিয়া নিকোলাভনা। ১৯০১ সালে জন্ম নেওয়া এই ফুটফুটে শিশুটি সাধারণ কোনো কন্যাসন্তান নয়। সে ছিল দ্বিতীয় টিসার নিকোলাসের সবচেয়ে ছোট কন্যা।

দ্বিতীয় নিকোলাস তখন রাশিয়ার রাজা। রাশিয়ায় সর্বশেষ রাজকন্যা অ্যানাস্তাসিয়া। জীবনের শুরুতেই সে রাজার দুঃখ হয়ে এসেছিল।

রাজপরিবারে এরই মধ্যে একাধিক কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছে। রাজার খুব ইচ্ছা এবার বুঝি পুত্রসন্তান হবে। এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ কর্ণধারের খোঁজ চাই। কিন্তু তা হয়নি। তবুও রাজকন্যাকে অবজ্ঞা করেননি তিনি। তার নাম রাখলেন অ্যানাস্তাসিয়া। এ নামের মানেই যে জেল ভেঙেছে। অন্যভাবে বললে যে শৃঙ্খলা ভেঙেছে।

এ নাম রাখার একটি সুন্দর গল্প আছে। ছোট রাজকন্যার জন্মসংবাদ শুনে রাজা বেশকিছু বিদ্রোহীদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। রাজকন্যা বলে খুব আয়েশি জীবন তার জন্য নির্ধারিত ছিল এমনটি ভাবলে ভুল হবে। সে বিশাল রাজপ্রাসাদে খুব সাধারণভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। সে একা নয়, অন্য রাজকন্যাদের কপালেও রাজবিলাস জোটেনি। তাকে রাজকীয় খাবার দেওয়া হলেও সেখানে সব ধরনের খাবার থাকত না। ঘুমুতে হতো শক্ত কার্পেটের ওপর। শুধু অসুস্থ হলেই একটু রাজকীয় সেবা মিলত।
রাজপরিবারে খাবার ও পোশাক দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাধারণের। সে কিন্তু এতটা পায়নি। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে তাকে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করানো হতো। রাজকন্যা হয়েও তাকে হাতের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। উলের কাজই সে বেশি করত। তার তৈরি উলের পোশাক বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা হতো।

অবশ্য রাজপরিবারে আদর না মিললেও দাস-দাসীদের প্রিয় রাজকন্যা ছিল সে। তারা তাকে ডাকত ‘গ্রান্ড প্রিন্সেস’ বলে। ইতিহাস কিন্তু তাকে দাস-দাসীদের দেওয়া মর্যাদার কথাই লিখে রেখেছে।

Anasthasia2অবশ্য অ্যানাস্তাসিয়া ছিল কোমলমতি। অহেতুক আভিজাত্য ও বিলাস সে এড়িয়ে গেছে। রাজকন্যা হয়েও সাধারণ জীবনে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। নিজেকে গ্রান্ড প্রিন্সেস বলে কেউ ডাকলে মনে করিয়ে দিত— আমি অ্যানাস্তাসিয়া।

রাজকন্যাকে নাম ধরে ডাকার এই অভাবনীয় উদাহরণ সত্যিই চমকপ্রদ। শৈশবেই সে নিজেকে আলাদা বলে প্রমাণ করেছে। নানা কাজে পারদর্শী, দুরন্ত ছিল সে। তার নীল চোখ সবার দৃষ্টি কেড়েছিল।

বাদামি চুল দুলিয়ে সে রাজপ্রাসাদ মাতিয়ে বেড়াত। তাকে বলা হয়, মেধাবী ও কৌতুহল জাগানো এক রাজকন্যা। তার ব্যক্তিত্ব তার মাকে অভিভূত করে।

একবার গভর্নরের সঙ্গে আলাপকালে মায়ের সঙ্গে উপস্থিত ছিল অ্যানাস্তাসিয়া। রাজ্যের অর্থপ্রবাহের নানা সংকট নিয়ে আলাপকালে সে একটি মন্তব্য করে বসে। শুরুতে তার এই অযাচিত মন্তব্যে সবাই বিরক্ত হলেও বুঝতে বাকি থাকে না তার কথার গুরুত্ব ঈর্ষণীয়। রাজকার্য পরিচালনায় কিশোরী বয়সেই তার এই অংশগ্রহণ ছিল অনন্য।

এ ছাড়া সে ছিল একজন দুর্দান্ত অভিনেত্রী। খেলাধুলায়ও তার আগ্রহ ছিল। একবার খেলতে গিয়ে গাছের মগডালে চড়ে বসে সে। তার খেলার সঙ্গী একান্ত দাসীরা। এ সময় তার দাসী ও শিক্ষকরা তাকে নেমে আসার জন্য বারবার ডাকলেও সে নেমে আসেনি। রাজকন্যার এই আচরণ তার শিক্ষকদের বিস্মিত করে। ঘটনা জানাজানি হলে রাজা রাজকন্যা ও তার শিক্ষকদের ডেকে পাঠান। শিক্ষকরা ভাবছিলেন আজ বুঝি নিশ্চিত মৃত্যু পরোয়ানা। কিন্তু রাজকন্যার বুদ্ধিমত্তায় তারা বেঁচে যান।

রাজকন্যা রাজাকে বলেন, মহামান্য, গাছে চড়ার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তারা দিচ্ছিলেন আমাকে। যেন কোনো হিংস্র পশুর আক্রমণে গাছে চড়ে জীবন বাঁচাতে পারি।

অ্যানাস্তাসিয়ার সবচেয়ে কাছের সঙ্গী ছিলেন তার বড়বোন মারিয়া। পরিবারের তাদের দুজনের আন্তরিকতা দেখে সবাই তাদের ডাকত ‘দ্য লিটল পেয়ার’।

দিন দিন বয়স বাড়ে। কিশোরী অ্যানাস্তাসিয়ার সাধারণ জীবন অসাধারণ হয়ে উঠেন তার কর্মগুণে।

এরই মধ্যে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় ঘরে বসে থাকেননি তারা। বড়বোন মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান যুদ্ধাহতদের হাসপাতালে। যুদ্ধাহতদের এই দুর্দশা থেকে দূরে সরে থাকতে পারেননি। দুজনেই নাম লেখান রেডক্রসে। রেডক্রসে ইতিমধ্যে নাম লিখিয়েছেন তার তার মা, অন্য বড়বোনেরাও।

রাজকন্যাকে কাছে পেয়ে যুদ্ধাহত সৈনিকরা তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়ে। যে কারণে অ্যানাস্তাসিয়ার নামেই একটি হাসপাতালের নাম রাখেন সৈনিকরা। হাসপাতালে রাজকন্যা নার্সের দায়িত্ব পালন করেন। ডাক্তারকে সাহায্য করার পাশাপাশি তিনি যুদ্ধাহত সৈনিকদের নানা গল্পে মাতিয়ে রাখতেন। গল্প বলার এই দারুণ অভ্যাস দেখে যুদ্ধাহতরা তাকে ডাকত ‘লাস্যময়ী কাঠবিড়ালি’ বলে।

১৯১৭ সাল। রাজ্যের অবস্থা করুণ। যুদ্ধের একপর্যায়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মাটির নিচে লুকানো কক্ষে জীবনযাপন করেছেন তিনি। আলেক্সান্ডার প্রাসাদের সেই গোপন কক্ষে থেকে রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিদারুণ জীবন কাটছিল। পরবর্তীতে বলভেশিক রেভুলুশনের সময় তারা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়েন।

ইতিহাসের বেশির ভাগ সূত্রই দাবি করে সেখানে রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অ্যানাস্তাসিয়াকেও হত্যা করা হয়।

তবে রহস্য জন্মায় লোকমুখে। অন্তত ১০ জন মহিলা স্পষ্টভাবে দাবি করেন, অ্যানাস্তাসিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। বছর তিনেক পরই আনা অ্যান্ডারসন নামে এক নারী নিজেকে অ্যানাস্তাসিয়া নামে পরিচয় দিয়ে বসেন।

তিনি একা নন, এ রকম ভণ্ডের সংখ্যা একাধিক যারা নিজেকে সেই হারানো রাজকন্যা বলে দাবি করেন।

এই রোমাঞ্চ আরও ঘনীভূত হয় তার কথিত মৃত্যুর ৭০ বছর পর। সে সময় দাবি করা হয়, তিনি এখনো জীবিত আছেন। একাধিক মানুষের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন।

রোমানোভ কবরস্থানে রাজপরিবারের একাধিক সদস্যের দেহ থাকলেও এটা নিশ্চিত নয় সেখানে অ্যানাস্তাসিয়ার দেহ রয়েছে কিনা। তাই তার মৃত্যু ও পালিয়ে যাওয়া কোনোটিই শতভাগ দাবি করা যায়নি। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, হারানো রাজকন্যা কোথায় আছেন? সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *