Skip to content

হেঁটে আমাজন পাড়ি

নাবীল অনুসূর্য
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশস্ত নদী আমাজন। এদিকে আয়তন কিংবা দুর্গমতা-দুই হিসাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর বনভূমি আমাজনের জঙ্গল। একজন খ্যাপাটে মানুষ কিনা ঠিক করলেন, আমাজন পাড়ি দেবেন হেঁটে! অর্থাৎ একেবারে আমাজন নদীর উৎস থেকে শুরু করে যেখানে আটলান্টিক সাগরে পড়েছে সে পর্যন্ত। মানে তাঁকে হাঁটতে হবে অন্তত চার হাজার মাইল বনাঞ্চল ও নদীপথ! তা-ও আবার সে পথের অনেক জায়গায় কোনো মানুষ পা-ই ফেলেনি। এমনই অসম্ভব এক পরিকল্পনা আঁটেন সাবেক ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন এড স্টাফোর্ড। এমন অভিযানে নামতে হবে, যা এর আগে কেউ কখনো করেনি-এই চিন্তা থেকেই তাঁর মাথায় আসে হেঁটে আমাজন পাড়ি দেওয়ার ভাবনা। স্পন্সর জোগাড়, বীমা করসহ সব ধরনের প্রস্তুতি শেষে আমাজন অভিযানে নামলেন ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল। যাত্রা শুরু করলেন মহাবনের পেরুর অংশ দিয়ে।

Amajan

একাকী রওনা হলেও, মাস কয়েক পরেই একজন জুতসই সঙ্গী জুটে গেল তাঁর। নাম গাদিয়েল চো সানচেজ রিভেরা। তাঁদের যখন দেখা হলো, স্টাফোর্ড তখন আমাজনের ‘রেড জোনে’ যাচ্ছেন। এলাকাটা মাদক পাচারের জন্য কুখ্যাত। খুন-গুম সেখানে নৈমিত্যিক ব্যাপার। পেরুর পুলিশও রেড জোন এড়িয়ে চলে। ওদিকে চো-র বন বিভাগের চাকরি গেছে সপ্তাহ কয়েক আগেই। সাত-পাঁচ ভেবে চো ঠিক করলেন, স্টাফোর্ডকে রেড জোনে একা পাঠানো ঠিক হবে না। স্টাফোর্ডও না করতে পারলেন না। ভয়ানক এলাকাটা অবশ্য তাঁরা এক রকম নির্বিঘ্নেই পাড়ি দেন। সময় লাগল পাঁচ দিন। ইতিমধ্যে স্টাফোর্ডের নেশাটা পেয়ে বসে চোকেও। ঠিক হয়, বাকি পথেও স্টাফোর্ডের সঙ্গী হবেন তিনি। স্টাফোর্ড যে পথে আমাজন অতিক্রমের পরিকল্পনা করেছেন, তাতে পেরুর পরেও আরো দুটি দেশ পাড়ি দিতে হবে-কলম্বিয়া আর ব্রাজিল।

অভিযানের পরবর্তী অংশ মোটেও নির্বিঘ্ন ছিল না। আমাজনে এখনো অনেক আদিবাসী বাস করে, যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়নি যান্ত্রিক সভ্যতার। তাঁরা সভ্যতার যতটুকু দেখেছেন, তার পুরোটাই হিংস্র-নষ্ট রূপ। এই আদিবাসীদের কাছে বাইরের মানুষের স্মৃতি বলতে আশি-নব্বইয়ের দশকে তাদের ওপর চালানো বর্বরতার স্মৃতি। বহিরাগতরা তাঁদের কাছে ‘পেলা কারা’। যারা গ্রামের মানুষদের মেরে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে যায়। স্টাফোর্ড-চোদের এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে পেরুতেই। তাঁদের প্রায়ই তীর-ধনুকের মুখে আটক হতে হয়েছে। একবার তো মাশাতে নামের এক আদিবাসী গোত্রের অঞ্চল পেরোনোার সময় বন্দি হন খুনের অভিযোগে। অনেক কষ্টে চো তাদের বোঝাতে পারেন, তাঁরা খুনি নন, স্রেফ অভিযাত্রী।

একে তো জঙ্গলটা বেশ ভয়ংকর। তাতে আছে ভয়ংকর সব প্রাণী। আছে বিষাক্ত সাপ। এদিকে তাঁদের বনের ভেতর দিয়ে ট্র্যাকিং করতে হবে মোটমাট আড়াই বছর। কাজেই বনের থেকেই খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করতে হতো। মশা আর বিচ্ছুর কামড় তো তাঁরা খেয়েছেনই। পেট ভরানোর জন্য মূলত মাছ খেতেন। সবচেয়ে সহজ শিকার ছিল পিরানহা মাছ। মাঝেমধ্যে আবার নদী থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে আসতেন। তখন সেটাও জুটত না ভাগ্যে। এ রকম একবার তো খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় মরতেই বসলেন। নদীও বেশ দূরে। তারপর হঠাৎই এক লালপেয়ে কাছিম পেলেন। একরকম নিরুপায় হয়ে মেরে খেলেন ওটাকে। আরেকবার বাধ্য হয়ে মারেন একটা ছাগল।

এভাবে আরো বছরখানেক পেরিয়ে গেল। গহিন জঙ্গল, খরস্রোতা নদী হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন দুই অভিযাত্রী। সঙ্গে কেবল কতগুলো ম্যাপ আর জিপিএস ডিভাইস। অভিযানের দেড় বছরের মাথায় বিশ্বমন্দার জেরে স্টাফোর্ডের মূল স্পন্সর প্রতিষ্ঠান টাকাকড়ি দেওয়া বন্ধ করে দিল। তবে অভিযান বন্ধ হলো না, মানুষের ভালোবাসার কারণে। অভিযানজুড়েই স্টাফোর্ড মোবাইলে ইন্টারনেট দিয়ে ব্লগ লিখছিলেন, ছবি আর ভিডিও আপলোড করছিলেন। তাতে যখন এ খবর জানালেন, হাত বাড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ। হংকংয়ের এক লোক তো একাই ১০ হাজার ডলার পাঠিয়ে দিলেন তাঁর অ্যাকাউন্টে। আমেরিকার এক স্কুলের বাচ্চারা পাঠিয়ে দিল তাদের টিফিনের পয়সা।

ব্রাজিলে পৌঁছে আরেক সমস্যা। জিপিএস ডিভাইসটি নষ্ট হয়ে গেল। শেষে তাঁদের পথ চলার পাথেয় বলতে রইল একটা কম্পাস আর একটা ম্যাপ। আসলে তখন তাঁরা পথ চলছিলেন স্রেফ অভিজ্ঞতা আর উপস্থিত বুদ্ধি দিয়েই।

৯ আগস্ট, ২০১০। এড স্টাফোর্ডের আমাজন অভিযানের ৮৬০তম দিন। আমাজন পেরিয়ে তাঁরা এসে দাঁড়ালেন আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে। চো জীবনে প্রথমবারের মতো সাগরের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। আর এড স্টাফোর্ড ইতিহাসের প্রথম মানুষ হিসেবে আমাজন মহাবন পাড়ি দিলেন হেঁটে।

পরে স্টাফোর্ড এই অভিযানের সময় তাঁর লেখা ব্লগগুলো একাট্টা করে ‘ওয়াকিং দ্য আমাজন’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটি হুলস্থুল বিক্রি হয়। অনূদিত হয় আটটি ভাষায়। আর তাঁর আমাজন অভিযানের ছবি ও ভিডিওগুলো নিয়ে ডিসকভারি বানায় একটা আস্ত টিভি সিরিজ।

ইতিহাসে নাম লেখাতে এড স্টাফোর্ডের এই একটি অভিযানই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাঁর রক্তেই যে অভিযানের নেশা। ২০১৩ সালে ডিসকভারি চ্যানেলের জন্য একটি অ্যাডভেঞ্চার সিরিজে কাজ শুরু করেন তিনি। সিরিজটির জন্য বিভিন্ন নির্জন অঞ্চলে স্রেফ একটা ক্যামেরা নিয়ে কাটিয়ে আসেন অন্তত ১০ দিন। কোনো কাপড়চোপড়ও সঙ্গে নেননি। প্রথম সিজনের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের ওলারোয় দ্বীপে তিনি কাটিয়ে দেন টানা ৬০ দিন! ওদিকে তাঁর সঙ্গী চো-ও বসে নেই। ২০১৩ সালে প্রথম নৌকায় চড়ে টিটিকাকা লেক প্রদক্ষিণকারীদের দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। আর এ বছর এক পোলিশ অভিযাত্রীকে নিয়ে আবারও বেরিয়েছেন আমাজন অভিযানে। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

DTC-Travel-ad

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *