তারিন হোসেন
ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউজে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু কাজ করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা বোর্ডের একজন সে। ওর সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়ের সূত্রিতা থাকলেও তেমন কোনো কথা হয়নি আমাদের। দু’জন দু’জনকেই চিনতাম।
প্রযুক্তির হাওয়া বদলে আমাদের নিত্যদিনের অভ্যেস আর সামাজিকতায় ফেসবুক যোগ হলে সেই বন্ধুটিই আমাকে ফেসবুকে অ্যাড করে। ফেসবুকেও তেমন একটা কথা হয়নি দু’জনের। তবে দু’জন দু’জনকে ভার্চুয়ালী কাজের ক্ষেত্রগুলো ফলো করতাম। তাতে দেখতাম সেই বন্ধুটির এফবি টাইমলাইনে সবসময় ওবামা’সহ কংগ্রেসম্যান, সিনেটরদের সাথে ছবি। তখন ওর কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কে আমিও একটা ধারণা পেলাম। অথচ পরস্পরের জীবনে ওই একবার কি দু’বার কথা হয়েছে। সেটাও হয়তো কলেজ লাইফে।
সম্প্রতি প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে আমি ছিলাম বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের একজন। আমরা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন কমপক্ষে আট থেকে বারো ঘণ্টা সেখানকার সিওপি২১ ভেন্যুতে সময় পার করতাম। প্রতিদিন সব আলোচনায় অংশ নেওয়া, তার রিপোর্ট তৈরিসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। জলবায়ু সম্মেলনে গিয়ে ওয়ার্ল্ড লিডারস ফোরামে আমি আল গোর, জন কেরী, নরেন্দ্র মোদী, পুতিনের সাথে দেখা বা তাদের কারও কারও সাথে ছবি তোলা হলো। স্বাভাবিকভাবেই তা আমার ফেসবুকে পোস্ট করি।
হোয়াইট হাউজ পার্টিতে…
জলবায়ু সম্মেলেনে বিশ্বনেতাদের সাথে আমার সেই ছবিগুলো দেখে আমার সেই বন্ধুটি আমাকে মেসেজ করে বলে-ও তুমি কপ-এ? আমারও যাওয়ার কথা ছিল প্রেসিডেন্টের সাথে। তখন আমি বললাম, হ্যাঁ আমার বাবা বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী এবং আমি খুব ক্লোজলি তার সাথে কাজ করি।
বন্ধুটি জানতে চাইলো, ‘তুমি কি ওয়াশিংটনে আসো?’
অর্থাৎ আমি যে প্রায় ছ’মাস পরপরই ওয়াশিংটনে যাই বা আমি দীর্ঘদিন যে ওয়াশিংটনেই কাটিয়েছি, সেটিও সে ট্র্যাক রাখে না বা তার জানারও কথা নয়। দু’জনের সেই রকমই দূরত্ব ছিল।
আমি বললাম, আমি তো প্রায়ই যাই। কথার পিঠে সে বলে, এর পরবর্তী সময়ে যখন ওয়াশিংটন ডিসিতে আসবে তখন আমাকে জানিয়ো, হোয়াইট হাউজে তোমার দাওয়াত রইলো।
তখন আমি খানিক রসিকতা ছুড়েই বললাম, তোমাদের ওখানে যখন হোয়াইট হাউজ পার্টি হবে তখন আমাকে বলো, আমি আসবো।
আমাকে অবাক করে সে তখনই আমাকে মৌখিকভাবে ইনভাইট করলো। আর শীত মৌসুমে তখন তো নানারকম আনুষ্ঠানিকতা থাকেই হোয়াইট হাউজে। সেক্ষেত্রে আমি নিজেও সৌভাগ্যক্রমে সেই দাওয়াতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলাম। আর এদিকে জলবায়ু সম্মেলনের অধিকাংশ জরুরি কাজ আমার শেষ হয়ে গেছে। তাই বাবাকে বললাম এই আমন্ত্রণের কথা। বাবাও সম্মতি জানিয়ে বললেন, যাও।
লিখিত আমন্ত্রণ পত্র পাওয়ার পর আমি ওয়াশিংটন যাওয়ার টিকেট কনফার্ম করলাম। ৯ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউজ পার্টি। খানিক আপন মনেই ভাবলাম, বিশ্ব এখন সর্বত্রব্যাপী সন্ত্রাসী হানায় বিপর্যস্ত। আমেরিকায় মুসলমানদের স্বাগত জানানো উচিত হবে কি-না এসব বিতর্ক যখন মিডিয়া জুড়ে তখন আমি একমাত্র মুসলিম বাংলাদেশি হিসেবে হোয়াইট হাউজের আমন্ত্রণে।
কয়েক কোটি মুসলমান বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। আমি নিজে কমপক্ষে বিশ বছর বসবাস করেছি যুক্তরাষ্ট্রে। নিজেকে আমি একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান হিসেবে মনে করি এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আমার পুত্র একজন আমেরিকান। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যসূত্র আমাকে চিন্তায় ফেলে দেয়-কোনটি আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আমার শিক্ষা নাকি আমার সন্তান। তার বক্তব্যকে ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করতে চাইনি, কিন্তু আমি এক্ষেত্রে অপারগ।
আমার শুভানুধ্যায়ীর দেওয়া হোয়াইট হাউসের আমন্ত্রণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই আমি। পরের দিন হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা ছাড়পত্রের ফরম আসে আমার ই-মেইলে। ফরমের প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখে তা পাঠিয়ে দিই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি ছাড়পত্র পাই এবং আমি রওনা হই বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট ভবনে।
হোয়াইট হাউজের অন্দরমহলে…
হোয়াইট হাউজে আমার ই-ইনভাইট ছিল। সান্ধ্য পার্টিটির গেট ২টায় খুলবে। সাউথ ইস্ট গেট দিয়ে আমার প্রবেশ। পুরোটাই এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের মতোই ব্যবস্থা। হোয়াইট হাউজের দুটো গেট-উইং ইস্ট উইং ও ওয়েস্ট উইং। পূর্ব দিকের গেট থেকে ইস্ট বিল্ডিংটি ২ মিনিটের পথ। সেটিও লেখা আছে আমার ইনভাইটেশনে। আর এই ২ মিনিটের হাঁটা পথে ৩ বার থামতে হলো। একবার ওরা থামিয়ে আইডি চেক করলো। এরপর তিনটি নিরাপত্তা বলয় পার হতে হতে আমার মনে হলো সমসাময়িক সময়ে এতো বড় বড় টেররিস্ট অ্যাটাক হলো, তার সেই অস্থিরতা বা অতিরিক্ত সন্দেহের চোখ কারও ভেতরে নেই। মাত্র কিছুদিন আগেই ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যাটাক হলো, তারপর ফ্রান্স অ্যাটাক, এর ভেতরে ডোনাল্ড ট্রাম এতো বাজে এক মন্তব্য করলো অথচ একমাত্র মুসলিম বাংলাদেশি অতিথি হিসেবে সিকিউরিটি গার্ড থেকে শুরু করে সব অফিসারদের চেহারা বা চাহনীতে কোনো ধরনের অসম্মান আমি লক্ষ্য করিনি। এটাই আসলে প্রকৃত আমেরিকান মানুষ। অথচ বিশ্ব মিডিয়া একটা ভয় তৈরি করে রাখে।
একটা ভীতির আবরণ তৈরি করে রাখে। আমি মূলত হোয়াইট হাউজ ভিজিটের জন্য এই সময়টা বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণও ছিল এটি। তারা কতটা সাধারণ ও উদারমনা তা নিজ চোখে দেখার জন্য। বিশ্ব মিডিয়ার এই ভুল পারসেপশনটা শুধরে দেওয়ার জন্য। এছাড়া আরেকটি উদারমন ও খুব উন্মুক্ত ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম যে, প্রতিটি জায়গাতেই ক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতি আছে। এটা কিন্তু আমাদের দেশসহ অনেক দেশেই খুব রক্ষণশীল করে রাখে।
উষ্ণ আতিথেয়তায়…
আমি যদিও তত্কালীন ডোনাল্ড-এর কমেন্টটা খুবই পার্সোনালি নিয়েই সেখানে গিয়েছি, কিন্তু বন্ধুর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। আমরা কি জানি, ইহুদি-মুসলিমরা সারাক্ষণ তর্কেই থাকে! কিন্তু আমি তো পেলাম না। এমনকি সে আমাকে দেখিয়ে প্রেসিডেন্টকে বললেন, ‘দিস ইজ মাই মুসলিম বাংলাদেশি ফ্রেন্ড।’
অর্থাত্ এই ভুল ধারণার ভেতর দিয়ে আমাদের পরস্পরের আক্রোশ বা দু’একটা বিচ্ছিন্ন মতামতের ওপরেই যে আমরা তা সামগ্রিক করে ফেলি এই ভুলটা আমি দিব্যচোখে দেখে এলাম। পৃথিবীর মহাশক্তিরা আসলে সরলীকরণেরই চেষ্টা করেন। ভুলটা নানা পর্যায়ে আরও বেড়ে যায়, ভ্রান্তির অপব্যাখ্যার কারণে।
ওই দিন সন্ধ্যায় আমি তো কেবল আমেরিকার একজন মুসলিম ছিলাম না, আমি ছিলাম হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত এমন একজন মুসলিম, যার আশেপাশে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, মিশেল ওবামা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমি এক অসাধারণ উষ্ণ অভ্যর্থনা অনুভব করেছিলাম হোয়াইট হাউসে, যা আমেরিকানদের কাছে ‘পিপল’স হাউস’ নামে পরিচিত। কোথাও আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাবনার ছায়ার দর্শন পাইনি, কোথাও কোনো ঘৃণা বা প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি আমার মনে ছায়াপাত করেনি। যুক্তরাষ্ট্র এমনই একটি মহান দেশ, যা শুধু সারাবিশ্ব থেকে আগত স্বপ্নাচ্ছন্ন মানুষরা বিনির্মাণ করেনি, একইসঙ্গে দেশটিকে তারা তৈরি করেছে মুক্ত মানসিকতা, সহনশীলতা এবং অন্যমত গ্রহণের মতো করে।
এছাড়া খাবারের আয়োজন আর বিশাল অর্কেস্ট্রা সঙ্গীতের মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যায় তাদের রুচিবোধ সেই সন্ধ্যাটা যেন স্মৃতি মেঘকে আরও স্বর্ণময় করে তোলে। আমার বন্ধু ভাইস প্রেসিডেন্টকে বলছেন, ‘দিস ইজ তারিন হোসেন, ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পত্রিকার প্রকাশক। ও মুসলিম।’ এছাড়া সব বিশ্বনেতাদের সাথে কথা বলে বুঝেছি যে ওনারা এতো ডাউন টু আর্থ এবং ডোনাল্ডের মতের কারণে এতো লজ্জা প্রকাশ করলেন, যা বলে বোঝাতে পারবো না। আমাকে এই ভাবে বললেন যে, প্লিজ তুমি তোমার দেশে গিয়ে তোমার জনগণদের বলবে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র, যার কারণে আমরা নিজেরা লজ্জিত।
তাদের এই উন্মুক্ত সরলোক্তি বা সহজিয়া আচরণ আমার বোধকে আরও যেন অবাক মুগ্ধতায় স্মরণীয় করে রাখে হোয়াইট হাউজে কাটানো কয়েকঘণ্টা।
লেখক : প্রকাশক ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক; সৌজন্যে : দৈনিক ইত্তেফাক