‘বর্মা (মিয়ানমার) ও থাইল্যান্ডের ওরা মানুষ না, কসাই। তবে ওরা জবাই করে না। মুক্তিপণের জন্য কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে আধমরা করে ফেলে রাখে। পরে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে একেকজন। এমন এক দিনও যায় না, যেদিন থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দিশিবিরে কেউ না কেউ মরে। কোনো কোনো দিন কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। সাগরতীরে মৃত্যু হলে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিতে আর জঙ্গলে হলে ঠাঁই হয় গণকবরের গর্তে। থাইল্যান্ডের দুর্গম বন্দিশিবিরে মুক্তিপণ, নির্যাতন, অনাহার এবং সর্বশেষ মৃত্যু- সবই একাকার। আমার কোলেও মারা গেছে ঢাকার এক যুবক। সব কিছুই ভুলতে পারব; কিন্তু সেই বন্দিশিবিরের পৈশাচিক নির্যাতনের কথা কিছুতেই ভোলা সম্ভব নয়। থাইল্যান্ডের সেই কসাইখানা থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব- এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।’
মাত্র আট দিন আগে থাইল্যান্ড থেকে ফিরে আসা ১৯ বছরের তরুণ রুবেল গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে এসব বলেন। তিনি কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের মরিচ্যা পালং গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে। ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ।
তরুণ রুবেল একটানা ১৮ দিন বন্দিশিবিরে কাটিয়েছেন। থাই উপকূলীয় এলাকা লেংডন থেকে মালয়েশিয়া সীমান্তের বাদামমুসা হয়ে পাতানি পর্যন্ত পাঁচটি বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছিল তাঁকে। এই কয় দিন এই তরুণকে কাটাতে হয়েছে নির্ঘুম। মুক্তিপণের জন্য তাঁকেও সইতে হয়েছে নির্মম নির্যাতন। থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত বন্দিশিবিরের দালাল সিন্ডিকেট সদস্যদের নির্মম নির্যাতনে রুবেলের কোমর ও পিঠ এখনো ক্ষত-বিক্ষত। বন্দিশিবিরের প্রধান দালাল মালয়েশিয়ার নাগরিক। তার নাম মনে করতে পারলেন না তিনি। তবে জানান, ওই দালাল মালয়েশিয়া থেকে থাইল্যান্ডের বন্দিশালায় আসা-যাওয়া করে। তবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান দালালের দায়িত্ব পালন করে আলী নামের এক রোহিঙ্গা। থাইল্যান্ডে দালালদের নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ নেই। তাদের ‘ফি’ (অর্থাৎ ভাই) বলে ডাকা হয়। বন্দিশিবিরে মুক্তিপণের দাবিতে নির্যাতন চালায় থাই ও মিয়ানমারের লোকজন।
রুবেল জানান, টেকনাফের নুরু নামের এক দালাল থাই বন্দিশিবিরে ভয়ংকর নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত। বেশ লম্বা ও সুঠাম দেহ তার। বন্দিশিবিরে প্রচার রয়েছে, নুরুর নির্যাতন মানেই দফারফা। টেকনাফের রমজানও রয়েছে নির্যাতনের দায়িত্বে। আকতার নামের এক রোহিঙ্গা আছে, যাকে সবাই কসাই আকতার নামে ডাকে।
রুবেল আরো বলেন, ‘থাইল্যান্ডের পাহাড়ে শুধু রাবারগাছ। সেই বনের ভেতরে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বন্দিশিবিরগুলো। আমরা যখন ছিলাম তখন সেখানে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হতো। সেই সঙ্গে ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। খালি পায়ে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটার কারণে পা ফুলে যেত। এ জন্যও অনেককে মরতে দেখেছি। শিবিরে খেতে দেওয়া হতো এক মুঠো ভাত আর সিদ্ধ দুই টুকরা পেঁপে। পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি পান করে বেঁচে ছিল তাঁর মতো অনেকে।’
কক্সবাজারের এই তরুণ সে দিনগুলোর বিভীষিকার কথা বলতে গিয়ে আরো জানান, এই দুনিয়ায় যদি কোনো খারাপ জায়গা থেকে থাকে সেটি হচ্ছে ওই বন্দিশালা। সেখানে বন্দিদের মধ্যে অনেক নারীও আছেন। তবে তাঁদের আলাদা করে রাখা হয়। তাঁরা সবাই রোহিঙ্গা। সেন্ট মার্টিনসের পূর্বে মিয়ানমার উপকূলের ঘোলারটেইলা নামক স্থানে নোঙর করে রাখা হয় মালয়েশিয়াগামী নৌকাগুলো। সেখানেই সংগ্রহ করে আনা রোহিঙ্গা নারীদের নৌকায় তোলা হয়। তাঁদের মারধর কিংবা নির্যাতনের শিকার হতে হয় না। তবে তাঁদের অনেককেই মরতে হয় শুধু অনাহারে। থাইল্যান্ডের দুর্গম পাহাড়ের বন্দিশিবিরগুলোতে খাবারের প্রচণ্ড অভাব। একেকটি শিবিরে আটক রাখা হয় ৭০০-৮০০ থেকে এক হাজারের বেশি লোক। এত বিপুলসংখ্যক লোকের জন্য ওই জঙ্গলে খাবার সংগ্রহ করা রীতিমতো দুরূহ কাজ। খাবারের অভাবে বন্দিরা যাতে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে না পারে, সে জন্য তাদের দেওয়া হয় এক ধরনের গুল। এতে কড়া নেশা হয়। এ ভয়ংকর মাদকও মৃত্যু ডেকে আনে। বন্দিশালার দালালদের কাছে মানুষের মৃত্যু যেন মামুলি ব্যাপার।
রুবেল চট্টগ্রামের একটি স্টিল কারখানায় চাকরি করতেন। বড় ভাই জামালের সঙ্গে তিনি টেকনাফের শহিদুল ইসলাম নামের এক মানবপাচারকারীর কবলে পড়েন। এখন থেকে ১৯ মাস আগে দুই ভাইকে শহিদুল টেকনাফের শাহপুরীর দ্বীপের ঘাটে মালয়েশিয়াগামী নৌকায় তুলে দেয়। টানা ছয় দিন ছয় রাত সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডের লেংডন বন্দিশিবিরে পৌঁছান রুবেল। পথিমধ্যে ছয়বার বিক্রি করা হয় তাঁদের। নৌকা থেকেই রুবেলের ভাই বিক্রি হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অন্য একটি নৌকায় চড়ে জামাল পাড়ি জমাতে সক্ষম হন মালয়েশিয়ায়। বন্দিশিবির থেকে রুবেলকে দিয়ে মোবাইলে বাপ-ভাইয়ের কাছে ফোন করে জানানো হয়, নগদ চার লাখ টাকা দিলেই শুধু তাঁর মালয়েশিয়া যাওয়া নিশ্চিত করা হবে।
টেকনাফের দালাল শহিদুল সেই চার লাখ টাকার জন্য গ্রামের বাড়িতে চাপ দিতে থাকে। অগত্যা গ্রামের ভিটি বিক্রির এক লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং জমি বন্ধকের এক লাখ ৫০ হাজার মিলে মোট তিন লাখ ২০ হাজার টাকা শহিদুলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার পরও নির্যাতন থামেনি। টানা ১৮ দিন কষ্ট সয়ে একদিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন রুবেল। এর পর থেকে তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। দীর্ঘদিন জেলে থেকেই তিনি শুনছেন শিবিরের চলমান নির্যাতনের কথা। কেননা প্রায় প্রতিদিনই বন্দিশিবিরের নির্যাতিত লোকজন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং তাদের ঠাঁই হয় কারাগারে। অবশেষে পরিবারের পাঠানো বিমান টিকিট হাতে পেয়ে ১৯ মাস পর থাইল্যান্ডের কারাগার এবং দুর্গম পাহাড়ের বন্দিশিবিরের নির্মম অভিজ্ঞতা নিয়ে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকায় ফেরেন রুবেল।
প্রতিবেশী হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোহাম্মদ ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, টেকনাফের দালাল শহিদুলের কাছে টাকা ফেরত চাইলে উল্টো রুবেলের ভাইদের ইয়াবার চালান দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় সে। সূত্র : কালের কণ্ঠ।