Skip to content

চখাচখির সনে চোখাচোখি

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ রাজশাহী
Rajshahiনৌকার ইঞ্জিন থামিয়ে দেন মাঝি। ইঞ্জিনের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না।
চারদিকে নিস্তরঙ্গ জলরাশি। একটা ছোট্ট ঢেউ পর্যন্ত নেই। হঠাৎ কানে এসে লাগে দূরে কোনো গল্পের আসর থেকে ভেসে আসা শত কণ্ঠের গুঞ্জন। অচেনা সব স্বর: আঙক, আঙক, আআখ, পক-পক-পক-পক…।
বরকত বললেন, ‘গল্প করছে খয়রা চখাচখি।’
১ মার্চ সকাল। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। নৌকায় উঠতে না উঠতেই শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টি আমলে নেওয়ার সময় নেই। শুধু ক্যামেরার জন্য একটি ছাতা মেলে ধরা হলো। ইঞ্জিনের নৌকা বিকট শব্দ তুলে রাজশাহী নগরের শ্রীরামপুরঘাট থেকে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে।
পদ্মার চরে পাখি দেখব আমরা। দলে আছেন ফিনল্যান্ডপ্রবাসী পর্যটক ও রাজশাহী বার্ড ক্লাবের আহ্বায়ক তানভীর অপু, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহসভাপতি তারেক অণু, রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সদস্য তাজমুল হোসেন, সবুজ ও বরকত উল্লাহ।Rajshahi2
দুই বছর আগেও একজন পাকা পাখি শিকারি ছিলেন বরকত। তবে তাঁর মন বদলেছে। এখন আর পাখি শিকার করেন না। কখনো পাখি শিকার না করতে শপথও নিয়েছেন তিনি। পদ্মা নদীর কোন বাঁকে, কোন চরে কী পরিমাণ পরিযায়ী পাখি আছে, সব তাঁর জানা। এ কারণেই এই মিশনে তাঁকে সঙ্গে নেওয়া।
মাঝনদীতে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করার পর শত কণ্ঠের গুঞ্জনের উৎস খুঁজে ফেরে আমাদের উৎসুক চোখ-কান। কিছুক্ষণ পর বুঝতে বাকি থাকে না—নৌকার পূর্ব দিকে অবস্থিত চরের এক জায়গা থেকে ওই গুঞ্জন ভেসে আসছে। কিন্তু খালি চোখে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
চোখে দূরবীন লাগাতেই পাখিদের এক অচেনা অভয়ারণ্য কাছে এসে যায়। অবিশ্বাস্য সেই দৃশ্য। নৌকায় থাকা সবাই একে একে চোখে দূরবীন লাগান। তখনো টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। সূর্যের দেখা নেই। আলো কিছুটা কম। কাছে যেতে পারলে ভালো হয়।
আস্তে করে তারেক অণু বললেন, ‘কোনো কথা নয়। কেউ উঠে দাঁড়াবেন না। একদম জেলেনৌকার মতো করে যেতে হবে। ওরা জেলেদের বিশ্বাস করে। অনেক কাছে ঘেঁষতে দেয়।’
Rajshahi4পাখিদের কাছাকাছি যেতে নৌকার ইঞ্জিন চালু করতেই হলো। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ, দূরবীন, ক্যামেরা—এসব যন্ত্রপাতিকে হয়তো ওরা ভালো চোখে দেখে না। আর আমাদেরও জেলে মনে করেনি। এ কারণে কাছাকাছি না যেতেই একসঙ্গে আকাশে উড়াল দিল একঝাঁক পাখি। পাখিদের রঙে সাজে আকাশ।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহসভাপতি তারেক অণু জানালেন, ইউরোপের দেশগুলোতে এই পাখিরা মানুষের খুব কাছাকাছিই থাকে। কিন্তু এ দেশে এলেই ওরা হিসাব করে চলে। ওরা জানে—জায়গাটা নিরাপদ নয়। সে জন্য ১০০ মিটারের বেশি কাছে ওরা মানুষকে ভিড়তে দেয় না।
চখাচখি অসাধারণ সুন্দর হাঁস। তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির চখাচখির দেখা মেলে—খয়রা চখাচখি ও পাতি চখাচখি। আমরা দেখছি ‘খয়রা চখাচখি’। ইংরেজি নাম ‘Ruddy Shelduck’। সারা গা প্রায় কমলা রঙের। পুরুষের গলায় একটা কালো রেখা আছে। কিন্তু ওড়ার সময় পাখায় কালো, সাদা, কমলা ও নীলচে রং বেরিয়ে আসে। এই হাঁসগুলোর দৈর্ঘ্য ৬৪ সেন্টিমিটার। ওজন দেড় কেজি। ডানা ৩৬ সেন্টিমিটার। ঠোঁট ৪ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার। পা ছয় ও লেজ ১৪ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। মে-জুন মাসে তিব্বতে এদের প্রজনন হয়।
তারেক অণু বলেন, বেশ বড়সড় ও দেখতে সুন্দর হওয়ায় এই পাখিরা সহজেই শিকারিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
খয়রা চখাচখির পাশেই দেখা গেল কয়েকটি ‘Gadwall’। আমাদের দেশে এরা পিয়ং হাঁস নামে পরিচিত। এদের রং আমাদের বাড়িতে পোষা হাঁসের কাছাকাছি—কালচে ছাই। উড়ন্ত অবস্থায় এই পাখির পাখার নিচ থেকে বেরিয়ে আসে সাদা রং।
আমরা আরও পুব দিকে যেতে থাকি। বাঁ পাশে—চরের ভেতরে যেখানে অল্প পানি, সেখানে এবার দেখা গেল একসঙ্গে অনেক প্রজাতির পাখি। তখন বৃষ্টি কমে এসেছে। কিন্তু আলো এখনো কম। নৌকা থেকে চরে নেমে কিছুদূর এগোতেই দল বেঁধে উড়তে শুরু করে বিচিত্র পাখিরা।
নদীর দক্ষিণ তীরে চরখিদিরপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি চালায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বঞ্চিতি বদল’। খানিকটা সময় কাটানোর জন্য আমরা ওই বিদ্যালয়ে গেলাম।
বিদ্যালয়ের একজন সংগঠক মোসলেম উদ্দিন। আমাদের পেয়ে মহা খুশি তিনি। বাড়িতে আয়োজন করলেন খাবারদাবারের। ওই বাড়ির সামনে কদমগাছের নিচে চেয়ার পেতে বসি আমরা। সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজ দক্ষিণে ভারতীয় সীমান্ত পিলার।
কথায় কথায় মোসলেম বলেন, ‘আমাদের চরের কোনো মানুষ পাখি মারে না। আমার বাড়িতে ঘুঘু পাখি বাসা বেঁধেছে। বাচ্চা ফুটেছে। কিন্তু আমরা কেউ ওদের ধরি না।’
চট করে তানভীর অপু উঠে যান। মোসলেম উদ্দিনের বাসায় ঘুঘুর বাসা থেকে দুটি ছানার ছবি তুলে আনেন তিনি।
কথা প্রসঙ্গে মোসলেম উদ্দিন বললেন, ‘শুধু আমরা একা চেষ্টা করে পাখি সংরক্ষণ করতে পারব না। শহরে থেকে যাঁরা নৌকা নিয়ে পাখি মারতে আসেন, তাঁদের ঠেকাতে হবে।’
মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি থেকে বের হতেই আকাশে সূর্য ওঠে। নদীতে নৌকা ভাসাতেই দেখা মেলে একঝাঁক চখাচখির। দূরবীন ছাড়াই অনেকটা পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে পাখিদের। নদীর পানির ওপরে সূর্যের আলোকচ্ছটায় ঝলমল করছে একেকটা চখাচখি। এবার আমাদের নৌকাটাকে অনেকখানি কাছে ঘেঁষতে দিল পাখিদের দল। একপর্যায়ে দিল আকাশে উড়াল। সেই দৃশ্য শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবিকেও হার মানায়।
সেখান থেকে পশ্চিম দিকে ফিরতে ফিরতে আরও কয়েকটি পাখির দলের সঙ্গে দেখা মেলে। এক জায়গায় এসে আমরা একটা চরে নামলাম। চরের মাঝখানে লেকের মতো একটা জায়গা। তার ভেতরে অগণিত চখাচখি। ওরা সেই গল্পে মশগুল। দূরবীন দিয়ে দেখার পর হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোতে থাকি। অনেকটা কাছে যাওয়ার পর একসঙ্গে পাখা ঝাপটে প্রায় মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় একঝাঁক চখাচখি।
সেখান থেকে এবার পশ্চিম দিকে নৌকা চলে। তারেক অণু বললেন, ‘এবার আমরা সবচেয়ে বেশি পাখি দেখব।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাখির রাজ্যে এসে পড়ি আমরা। আগেই সবাইকে শর্ত দেওয়া হয়েছে—কোনো কথা বলা যাবে না।
নৌকার ইঞ্জিন আবার বন্ধ করে দেওয়া হলো। আপন গতিতে ভাসছে নৌকা। এবার পাখি গুনতে শুরু করেন অণু। তাঁর হিসাবের তালিকায় আছে—খয়রা চখাচখি, পাতি চখাচখি, উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস, পিয়ং হাঁস, পাতি তিলি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, পাতি ভতিহাঁস, ছোট নথজিরিয়া, পাকরা উল্টো ঠোঁটি, ছোট বাবুবাটান, নদীয়া পানচিল, ছোট পানচিল, মাছমুরাল, লালকোমর আবাবিল, বালি নাকুটি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, এশীয় শামখোল। সব মিলে ১৮ প্রজাতির দুই সহস্রাধিক পাখি। এর মধ্যে চখাচখিই বেশি।
পাখি দেখতে দেখতে বেলা দুইটা পেরিয়ে যায়। ফেরার বেলায় মনে হয়—কীভাবে পেরিয়ে গেল এতটা সময়!
সূত্র : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *