Skip to content

বৃষ্টির ভিতর চেরাপুঞ্জি

Cherapunji শিহাব শাহরিয়ার
২৫ মে ২০০৬ সালে গিয়েছিলাম ভারতের পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্রস খ্যাত আসামের গোয়াহাটি, মেঘালয়ের নান্দনিক শহর শিলং আর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত অঞ্চল চেরাপুঞ্জি। এখানে একটু বলে রাখি, আগে চেরাপুঞ্জিই ছিল এক নম্বর কিন্তু বর্তমানে বৃষ্টি বর্ষণের এক নম্বর স্থানটি হয়েছে মৌসুমগ্রাম। চেরাপুঞ্জির পাশেই জায়গাটি।

দেখার কোনো শেষ নেই- এই কথাটিরই প্রমাণ পাওয়া যাবে চেরাপুঞ্জি গেলে। বহুদিনের ইচ্ছে ছিল চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি দেখবো। সেই ইচ্ছেই পূরণ হলো। সে কথায় পরে আসছি। আগে বলি, কীভাবে শিলং গেলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আমিনুল ইসলাম খানকে সঙ্গে নিয়ে ২৪ তারিখ রাতে ১ মাসের ভিসা নিয়ে প্রথমে ঢাকা থেকে সিলেট যাই। বিলাসবহুল বাসে আরামদায়ক জার্নি হলো। আমরা যাচ্ছি বাংলাদেশের তামাবিল ও ভারতের ডাউকি সীমান্ত দিয়ে। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই সিলেট থেকে একটি এসি-কারে তামাবিল যাত্রা করি। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় আর পরিমল বাতাস ভেদ করে ঘণ্টাখানেকের পথ অতিক্রম করে প্রথমেই গেলাম জাফলং। কারণ অতো সকালে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস অফিস খোলেনি। প্রায় ২৫ বছর পর সকালের জাফলং দেখলাম। পাথর তুলে তুলে পাহাড়ি নদীর সৌন্দর্য নষ্ট করে ফেলেছে মানুষেরা। গাড়ির ড্রাইভার বলল, স্যার চেকপোস্টে আরও পরে গেলেও চলবে, গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে দেখতে পারেন। বন্ধু আমিন ঘুরে দেখতে চাইলো কিন্তু আমাকে আগের মতো আকর্ষণ করলো না জাফলং, আর অতো সকালে খাসিয়া আদিবাসী পাড়ায় ঢোকার সুযোগও ছিল না। মিনিট দশেক জাফলংয়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করে চলে এলাম তামাবিল সীমান্তে। তামাবিল সীমান্তে এই প্রথম আসা। বেনাপোল-হরিদাসপুর সীমান্তের ইমেজ তামাবিল ডাউকিতে নেই। এখানে অন্য রকম দৃশ্য, অন্য রকম অনুভূতি, অন্য রকম ভালো লাগা। আমাদের গাড়ি তামাবিল চেক পোস্টের অনতিদূরে থামল। আমরা নেমেই তাকালাম উঁচু অতি কাছের পাহাড়ের দিকে। মাত্র কয়েক গজ জায়গা পেরোলেই অন্য একটি দেশ, ভিন্ন একটি ভাষা আর অচেনা শিলং- এসব মনে মনে ভাবছি। ভাবতে ভাবতেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন দু’জন বিডিআরের জোয়ান। এসেই আমাদের পরিচয় নিয়ে কথা বললেন আন্তরিকতার সাথে এবং আমাদেরকে কাস্টমসের ভিআইপি রেস্টরুমে বসার ব্যবস্থা করলেন।

Cherapunji3বসে বসে দেখছি, ওপারে অনেকগুলো কয়লা বোঝাই ট্রাক সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে এপারে অর্থাৎ বাংলাদেশে কয়লা নিয়ে আসার অপেক্ষায়। দেখছি বিশাল বিশাল পাহাড় গায়ে সবুজ জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান আর শেরপুরের গাজনির কথা। বান্দরবানের চিম্বুকে উঠেছি কিন্তু শিলং-চেরাপুঞ্জির পাহাড়ের উচ্চতা অনেক অনেক শুনেছি। কারণ ঢাকায় দু’জন বন্ধুর কাছ থেকে শিলং সম্পর্কে কিছু জেনে এসেছি; যারা আগে শিলং ও চেরাপুঞ্জি ঘুরে এসেছে। এদের একজন তরুণ কথাশিল্পী হামিদ কায়সার ও সাংবাদিক সম্পাদক সুকান্ত গুপ্ত। দু’জনেই বলেছে, শিলং যেতে পাহাড়ি পথে এক অন্য রকম অনুভূতি হবে।

বেলা ৯টার দিকে ইমিগ্রেশনের লোক এলো। আমরা আমাদের পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র দেখিয়ে কাস্টমস অফিসের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মন যেখানে যাওয়ার জন্য আনচান করছিল, সেই শিলং-এর উদ্দেশে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ধীরে ধীরে মেঘালয়ের ডাউকি সীমানায় প্রবেশ করলাম। বিএসএফ ও ভারতীয় কাস্টমসের চেকিং ও আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ডাউকি থেকে শিলং যাওয়ার জন্য ট্যাক্সির খোঁজ করছিলাম। ঢাকা থেকে জেনে এসেছি যে, ডাউকি থেকে দু’টি সার্ভিস চালু আছে। এক ট্যাক্সি, দুই সমু সার্ভিস নামের জিপ কার। সমু ভাড়া করে অজানা, অচেনা অন্য দেশের অন্য শহরের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। ভোরের কাগজের নির্বাহী সম্পাদক বন্ধুবর অলক গুপ্ত আগেই বলেছিল যে, ডাউকি থেকে শিলং-এর রাস্তা পুরোটাই নিবিড় পাহাড়ঘেরা। হ্যাঁ অলকের কথার প্রমাণ পেতে শুরু করলাম। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, মেঘালয়ের এই অঞ্চলে মূলত খাসিয়া আদিবাসীদের বসতি। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারও একজন খাসিয়া। এদের চারটি ভাষা- মাতৃভাষা খাসিয়া, হিন্দি, বাংলা এবং ইংরেজিও অনেকটা বলতে পারে। আমরা যাচ্ছি ক্রমশ উপরে, আঁকা-বাঁকা, ঘন পাহাড়ি পথ পেরিয়ে। যেতে যেতে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছি। পাশেই ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়। যেতে যেতে আমরা এতো উপরে উঠে যাচ্ছি যে, গাড়ি থেকে পাশে তাকালে রীতিমতো ভয় করে, কারণ পাশের পাহাড়ি খাদ অনেক নিচে। গাড়ি থেকে দেখছি- পাশের উচুঁ পাহাড়গুলোতে শাদা শাদা মেঘ। এই প্রথম দেখলাম পাহাড় আর মেঘের স্পর্শ। অপূর্ব সেই দৃশ্য। আমরা গাড়ি থামিয়ে ছবি তুললাম। যেখানে থামলাম, সেটি ভূমি থেকে প্রায় ৫ হাজার ফিট উপরে। আমাদের মতো আরও কয়েকজন বিদেশী ভ্রমণকারী গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছে। বড় নির্জন আর সবুজ পাহাড়ঘেরা এই স্থান যেন অন্য এক পৃথিবী।

Cherapunji4আমরা আবার যেতে শুরু করলাম। আঁকা-বাঁকা, ইউ-টার্নের কিলো কিলো পথ। এমন পথে যেতে অনেকে ভয় পায়, অনেকে বমিও করে বলে পার্শ্ব-যাত্রীর মুখে শুনেছি। এরকম দুর্গম পাহাড় ভেদ করে আঁকা-বাঁকা রাস্তা তৈরি করেছে ব্রিটিশরা। মনে পড়ছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কথা। পাহাড়ি এই মেঘালয় রাজ্যটি বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুর জেলার পার্শ্ববতী রাজ্য। মুক্তিযোদ্ধারা এই মেঘালয় রাজ্যেই আশ্রয় গ্রহণ করে, প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে। পুরো মেঘালয় প্রদেশটিই পাহাড়ি অঞ্চল। রাস্তার দু’পাশেই কিছু খাসিয়া আদিবাসী ছাড়া লোক-বসতি নেই বললেই চলে। আমাদের গাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিটি বললেন, এই সব পাহাড় পাথর, চুনাপাথর, কয়লা আর সিমেন্টের জন্য বিখ্যাত। একজন বললেন, সমস্ত মেঘালয়ে যে পরিমাণ পাথর আছে, তা দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রাস্তা বানানো যাবে। বাস্তবে দেখছিও তাই- পাহাড়ের গায়ে পাথর আর পাথর।

প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পেরিয়ে শিলং শহরের দেখা পেলাম। পাহাড়ের গায়ে, উপরে-নিচে, পরিকল্পিত নকশার মতো বাড়ি-ঘর দেখে দেখে একদিকে চেরাপুঞ্জির রাস্তা রেখে শিলং শহরের দিকে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করলো। ড্রাইভারের প্রশংসা না করে পারা যায় না, কারণ এতো ভালো করে গাড়ি চালাতে আমি এই প্রথম দেখলাম। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগলো- শিলং। এক অন্য রকম শহর। পৌনে তিন ঘণ্টার জার্নি শেষে দুপুরে শিলং শহরের মূলে এসে আমরা নামলাম। আমাদের সঙ্গের দম্পতি বললেন, খাবার জন্য এই শহরের সবচেয়ে ভালো হোটেল হলো ‘বাবা হোটেল’; যে হোটেলের সামনেই আমরা নেমেছি। বয়স্ক হিন্দু দম্পতি চলে গেলেন শিলং-এ তাদের আত্মীয়ের বাসায়, বাকি আমরা সবাই ঢুকলাম বাবা হোটেলে। পর্যটন শহর বলেই খাবার দাম একটু বেশি। বাঙালি খাবার সবই আছে। তবে কলকাতার চেয়ে দাম বেশিই। সবজি, টেংরা মাছ, ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। ব্যবসায়ী দম্পতি চলে গেলেন আসামে। বাকিরা চললাম হোটেল খুঁজতে। হেঁটে হেঁটে অনেকগুলো হোটেল দেখলাম, কিন্তু কোথাও সিট পেলাম না। পরে আমি ও বন্ধু আমিন একটা ট্যাক্সি নিয়ে শিলং-এর দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং রাত্রে শহরের কেন্দ্রে মিকাসা হোটেলে উঠলাম।

ছোট্ট, সুন্দর শহর শিলং। চতুর্দিকেই পাহাড়। খাসিয়া আদিবাসীরা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে আছে। অনেক বাঙালিও আছে। মূলত পর্যটন শহর বলেই প্রচুর হোটেল রয়েছে। শহরের প্রধান বাহন ট্যাক্সি। প্রধান মার্কেটের নাম পুলিশ মার্কেট। স্থানীয় সময় দশটা থেকে শহর সরগরম হয় আর সন্ধ্যা আটটার পর দোকানপাট ও রাস্তাঘাট সব নীরব হয়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম চড়া। শহরের মূল ভাষা হিন্দি, তারপর বাংলা, ইংরেজি, অসমীয়াসহ আঞ্চলিক ভাষাও রয়েছে। লেক, মিউজিয়ামসহ অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান আছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি বছরের এই তিনমাস শিলং-এ প্রচণ্ড শীত অর্থাৎ মাইনাস ৫/৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা নেমে আসে। সেই সময় শহরে লোকজনের বসবাস কমে যায়। আর বাকি সময় জমজমাট থাকে শহর।

ভারতের পূর্বাঞ্চলের মেঘালয়া, আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরা, নাগালেন্ড, অরুণাচল ও মিজোরাম এই সাতটি অর্থাৎ সেভেন সিস্টার্রস বলে খ্যাত প্রদেশের কেন্দ্র হলো আসামের রাজধানী গোয়াহাটি। কাজেই শিলং প্রবেশ ও গমনের পথও গোয়াহাটি। আমরা ২৬ তারিখ দুপুর একটায় সমু সার্ভিসযোগে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে গোয়াহাটি গেলাম। যাবার পথে সেই একই অপরূপ দৃশ্য। যা দেখে প্রথম দর্শনার্থীদের চোখ ও মন ভরে যাবে অজানা আনন্দে। যেতে যেতে কৌতূহলী চোখে দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমরা গাড়ি থেকেই হ্যান্ড ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছি পাহাড় আর মেঘমালার। কতদিন শুনেছি মেঘ পাহাড়ে মিলন হয়। আজ তা বাস্তবে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। কোথাও পাহাড়ের চূড়ায়, কোথাও পাহাড়ের মাঝ-শরীরে শাদা-কালো মেঘেরা স্পর্শ করছে। শাদা ধোঁয়া অথবা কুয়াশার মতো মেঘগুলো পাহাড়ের গায়ে মিশে যাচ্ছে আর রাস্তা-ঘাট গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। গাড়ির পিছনের সিটে মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক আমাদের বাংলায় কথাবার্তা ও ছবি তোলার আয়োজন দেখে নিজেই জানতে চাইলেন আমরা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছি? পরিচয় পাবার পর তিনি একটি অপূর্ব জায়গায় গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে বললেন, তার বাবা-মা’র আদি নিবাস বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ধামরাই-এ। তিনি একবার হলেও সেখানে যেতে চান।

স্নিগ্ধ সবুজের সমারোহ আর পাহাড়ি পথ পেরিয়ে সমতলে বাংলাদেশের মতো মফস্বল শহরের দেখা পেলাম। সমতল থেকেই শুরু হলো অসমের গোয়াহাটি। গোয়াহাটি শহরে আমরা পৌঁছলাম বিকেল চারটায়। গোয়াহাটির মানুষের চেহারার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের তেমন কোনো পার্থক্য চোখে পড়ল না। দেখলাম গোয়াহাটি সচিবালয় বিল্ডিংটি অন্যরকম নান্দনিক অবকাঠামোয় দাঁড়িয়ে আছে। এই শহরের প্রধান মার্কেট হলো ফেঞ্চি মার্কেট। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ঢুকলাম মার্কেটে। কিছু কেনাকাটা করে শহরে কিছুক্ষণ ঘুরলাম। ইচ্ছে ছিল দর্শনীয় স্থান দেখার আর আমার জন্মস্থান শেরপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আদি ব্রহ্মপুত্রের আদিস্থান দেখা এবং ব্রহ্মপুত্রে নৌকা ভাসিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবার সে ইচ্ছে অপূর্ণ রেখেই সমুসার্ভিসে উঠে চলে এলাম শিলং-এ। রাত এগারোটার দিকে শিলং শহরে ঢুকেই দেখলাম শহর একদম জনশূন্য, নীরব-নিস্তব্ধ। গাড়ির চালক আমাদেরকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। আমরা হোটেল কক্ষে গেলাম রাতের নিদ্রার জন্য।

পরদিন ২৭ মে ২০০৬। রাত থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে বুঝতে পারিনি। সকালে উঠে স্নান সেরে নাস্তা খেতে বাবা হোটেলে যাবো, তখনই দেখলাম বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিকে আর্শীবাদই মনে করলাম। কারণ শিলং-এ বৃষ্টি মানেই চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি। আমাদের আজ চেরাপুঞ্জিতেই যাবার কথা। শুনলাম এটিই মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাত। আগের দিন পুলিশ মার্কেটে দেখা হয়েছিল কলকাতা থেকে আসা একটি বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। তারা জানালো গতকাল (২৫ মে ২০০৬) চেরাপুঞ্জি গিয়েছিলো বৃষ্টি দেখতে কিন্তু বৃষ্টির দেখা পায়নি। সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান বলতে হবে। হোটেলের ম্যানেজার দীপক বাবুর সঙ্গে আমাদের একটু বেশি খাতির হলো কারণ তার বাড়ি কুমিল্লায় এবং শিলং পৌঁছার প্রথম দিন বিকালে যে ট্যাক্সি ড্রাইভার মফিজকে পেয়েছিলাম ওর বাড়িও কুমিল্লা। হোটেলের একজন কর্মচারী ওর বাড়ি মাদারীপুর অর্থাৎ এরকম অনেক বাংলাদেশী শিলংএ আছে কাজের সূত্রে। এদের অনেকেই আর বাংলাদেশে আসে না। যাক, দীপক বাবুই একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দিল চেরাপুঞ্জিতে যাবো-আসবো। ভাড়া ভারতীয় টাকায় আটশ। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, শিলং-এর ট্যাক্সি চালকরা খুবই চতুর এবং প্রতিদিন চেরাপুঞ্জি, ডাউকি কিংবা গোয়াহাটি যাতায়াত করার কারণে বিশেষ করে পর্যটকদের মন-মানসিকতা সহজেই তারা ধরে ফেলতে পারে, ফলে আমাদের ট্যাক্সি চালক, রবিও আমাদেরকে বুঝে ফেলল সহজেই। চালক বলল, সে নিজেই চেরাপুঞ্জির দর্শনীয় স্পটগুলো দেখানোর চেষ্টা করবে। দেখছি, বৃষ্টিতে শিলং-এর অন্য রকম চেহারা। রাস্তায় প্রতিটি মানুষের হাতেই ছাতা। গাড়ি শহর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, আমরা দুদিকে দেখছি এক স্বপ্নিল সৌন্দর্য। পাহাড়ি উচুঁ-নিচু পথ পেরিয়ে যে দিকেই তাকাচ্ছি, দেখছি নতুন এক পৃথিবী। দেখছি, মেঘ আর বৃষ্টি খেলা। সংস্কৃত ভাষায় ‘মেঘালয়’ শব্দের অর্থ ‘মেঘের আবাসস্থল’। বাস্তবেও দেখছি মেঘালয়ের পাহাড়গুলোতে মেঘেরা যেন বাসা বাঁধছে। পাহাড়ের স্পর্শে বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে ধরাকে শীতল করছে। হ্যাঁ, বৃষ্টি পড়ছে অঝর ধারায়।

Cherapunji2ইংরেজরা ১৮৬৪ সালে রাজধানী চেরাপুঞ্জি থেকে শিলং স্থানান্তর করেন। কারণ চেরাপুঞ্জির অত্যধিক বৃষ্টিপাত প্রশাসনিক কাজে যথেষ্ট বাধার সৃষ্টি করে। চেরাপুঞ্জির কাছেই ‘থাংকারাং পার্ক’ নামে একটি পাখিদের চমৎকার অভয়ারণ্য স্থাপন করা হয়েছে। বর্ষকালেই এই স্থানটি সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। আবার এই সময়েই অত্যধিক বৃষ্টির কারণে জীবনযাত্রা কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। আফসোস লাগছে, ডিজিটাল অথবা একটা জুম ক্যামেরা নিয়ে না আসায়। তারপরও সাধারণ একটি ক্যামেরা দিয়ে গাড়ি থেকেই নান্দনিক দৃশ্যগুলো বন্দি করতে শুরু করলাম। ক্রমশ উপরে উঠছি বৃষ্টি ভেদ করে। এখানেও আঁকা-বাঁকা পথ। উচিৎ ছিল রেইনকোট আর ছাতা সঙ্গে নেয়ার কিন্তু আমরা নিতে পারিনি। যাচ্ছি- দেখে ভালো লাগছে পৃথিবীর রূপ। আহা! এতো ভালো লাগাও কি আছে? যেতে যেতে চালক একটি জায়গায় গাড়ি থামালো। পাশে একটি ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি ও বাতাস বইছে। শাদা ধোঁয়ার মতো বৃষ্টি- বলতে গেলে কিছুই দেখা যায় না। চালক হাত দিয়ে দেখাল, ছাউনি থেকে পাকা সিঁড়ি তৈরি করে নিচের দিকে প্রায় হাজার ফিট যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে সিনেমা ও নাটকের শুটিং করা হয়। দেখলাম কয়েকজন বিদেশী পর্যটক রেইনকোট ও ছাতা নিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচেও পাহাড়। ডানে বামে সবদিকেই পাহাড়। আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। পাহাড় কেটে অপূর্ব রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টির জন্য আমরা রাস্তার দু’পাশের অনেক দর্শনীয় স্পটে নামতে পারছি না। রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি আর মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ডর পাহাড়ি ঝরনা দেখেছি দূর থেকে কিন্তু চেরাপুঞ্জির পাহাড়ি ঝরনাগুলা এতো কাছের মনে হচ্ছে যেন এই ঝরনাগুলো ঘরের স্ত্রী, যাকে সহজেই ছোঁয়া যায়। আর দূরের ঝরনাগুলো হলো প্রেমিকা, দেখা যায় কিন্তু সহজেই ছোঁয়া যায় না। বন্ধু আমিন নাছোড় বান্দা। বৃষ্টির মধ্যেই বার বার নেমে যাচ্ছে, গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ঝরনার পাশে, আমি গাড়ি থেকেই তার ছবি তুলে দিচ্ছি।

শুধু ঝরনা নয়। রাস্তার পাশের পাহাড়ের গায়েই রয়েছে পাথর। বড় বড় পাথরেরও একটা নান্দনিক শরীর আছে, তা এখানে এসে দেখলাম। পাথরের গা বেয়ে বেয় বৃষ্টির জল নেমে যাচ্ছে। ঘণ্টা দেড়েক পথ চলার পর আমরা পৌঁছলাম চেরাপুঞ্জির চূড়ায়। চূড়ায় পাহাড়গুলো অন্যরকম। এতোদিন যে পাহাড় দেখেছি বড় পর্দায়, ছোট পর্দায়- আজ তা দেখছি বাস্তবে। প্রায় ১৩০০ মিটার উপরে উঠেও পাহাড়ি সমতলে দেখলাম একদিকে কিছু বাড়ি-ঘর, অন্যদিকে গরু চড়ছে মাঠে, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুন্দরী ঝরনা। এই ঝরনাকে প্রেমিকা ভাবতেই ভালো লাগছে। অপূর্ব, অপূর্ব, অপূর্ব। গাড়ি থেকে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে গেলাম। ছুঁয়ে দিলাম প্রেমিকার ঈর্ষণীয় শরীর। মনে পড়ছে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা : ‘কী ভালো লাগছে আমার…কেমন করে বলি’।

প্রায় অর্ধ-ভেজা হয়ে গেলাম। তবু খারাপ লাগছে না। চেরাপুঞ্জিতে দর্শনীর সাতটি স্পট আছে। চালক প্রথমেই নিয়ে গেল নব কালিকাই জলপ্রপাতের কাছে। সেখানে বৃষ্টি আর বাতাসের এতো তাণ্ডব যে, গাড়ি থেকে নেমেই ভিজে গেলাম এবং প্রচণ্ড বাতাসে গা রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছে। মাত্র মিনিট দুই দাঁড়িয়ে ড্রাইভার কাম গাইড হাত দিয়ে দেখালো, ঐ যে তিনটি ঝরনা যা দিয়ে তিন রঙের জল পড়ে। তুমুল বৃষ্টির কারণে আবছা আবছা কিছু দেখতে পেলাম আর জল পড়ার শব্দ পেলাম। চেরাপুঞ্জির সর্বোচ্চ চূড়া এটি। ড্রাইভার বলল, স্যার এখান থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। এখন বৃষ্টির কারণে দেখা যাচ্ছে না। বুঝতে পারলাম বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি আছি, আরও বুঝতে পারলাম যে, চেরাপুঞ্জির এই বৃষ্টির জলই নেমে বাংলাদেশে যাবে, ভরে যাবে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর প্রভৃতি জেলার বিশাল বিশাল হাওর, নদী আর খালগুলো। ড্রাইভারের ইশারায় ট্যাক্সিতে উঠলাম। ও নিয়ে চললো অন্য একটি স্পটে। গাড়ির গ্লাস বন্ধ এবং বৃষ্টির জলে শাদা হয়ে গেছে। বাইরে ভারী বৃষ্টির লীলা-খেলা চলছে। আমাদের মতো অনেক দর্শনার্থী আছে। পরের স্পটে এসে দেখলাম দুটো ছোট টাওয়ার যেখানে থেকে দেখা যায় উঁচু পাহাড় থেকে সাতটি ঝরনার জল একসঙ্গে পড়ার দৃশ্য।

গাড়ি ছুটে চলছে অন্য একটি স্পটে। যেতে যেতে দেখলাম ছোট ছোট বাড়ি-ঘর। মানুষজন কম। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। জলগুলো গড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ঝরনাকৃতি নালা দিয়ে। তৃতীয় স্পটটি ভালো লাগলো। ড্রাইভার একটি দোকান থেকে দুটি ছাতা এনে দিলো আমাদের। আমরা টিকিট কেটে সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা উপরে উঠে পাথরের গুহার মধ্যে প্রবেশ করলাম। সব বয়সের অনেক দর্শনার্থী ভেতরে। কেউ কেউ ছবি তুলছে। কেউ কেউ গুহার সরু, দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছে। আমরা কিছু ছবি তুলে গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। ওখানেই পরিচয় হলো, কলকাতার বাঙালি একটি পরিবারের সঙ্গে। পরিবারের কর্তা সরকারি চাকুরে আমাদেরকে চা-বিস্কিট খাওয়ালেন একটি পাহাড়ি মহিলার পরিচালিত দোকানে। প্রাণ খুলে তাদের সঙ্গে কথা বললাম। বিদায় নিয়ে পুনরায় গাড়িতে উঠলাম। বাকি চারটি স্পট দেখার পরিস্থিতি আমাদের নেই কারণ আমাদের সমস্ত শরীর মূলত ভিজে গেছে। আমরা বৃষ্টির ভেতর ফিরে এলাম শিলং। ড্রাইভার ফেরার পথে ক্যাসেট থেকে শুনালো বাংলা গান। মনে হলো বাংলাদেশেই আছি। না বাংলাদেশে নয়, আছি বৃষ্টির ভেতর, পাহাড়ের কাছে, উপভোগ করছি জীবনের এক অপরিসীম সুখ।
সূত্র : রাইজিংবিডি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *